বাংলাদেশে চিকিৎসক এবং রোগীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, বিতণ্ডা এমনকি সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। যেকোনও ভুল বোঝাবুঝি থেকে দূরত্ব বাড়ে। হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের স্বজনরা নানা হল্লা করেন ঠিকই, কিন্তু চিকিৎসদের পক্ষ থেকে কোনও সেবা দিতে অস্বীকৃতির ঘটনাও কম না। চিকিৎসক ও রোগীর পারস্পারিক অবিশ্বাসের সম্পর্কও দেখা যায়— অফলাইনে, এমনকি অনলাইনেও।
রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, প্রশ্নের জবাব এবং যথেষ্ট সময় দেন না। অপরদিকে চিকিৎসকদের অভিযোগ, রোগীর স্বজনরা ‘শিক্ষিত’ আচরণ করেন না। যেটুকু জানানোর সেটা জানানোর পরেও তারা নানাবিধ জটিলতা তৈরি করেন। তারা তো চিকিৎসক না যে, সব বুঝবেন। চিকিৎসকরা এও বলছেন, আমরা কোনও রোগীর খারাপ চাই না। যেকোনও সময় রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হতেই পারে। এটুকু মাথায় থাকে না কারও। তবে বাস্তবতা হলো, রোগীর প্রধান অভিযোগ— চিকিৎসকরা রোগীর সেবায় প্রয়োজনীয় সময় দেন না।
দেশে এমনিতেই জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার ও সেবাকর্মীর সংখ্যা অনেক কম। বিএমডিসির নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার। এরমধ্যে সরকারি ৩৩ হাজার, বেসরকারি ৮৭ হাজার। এত অল্প সংখ্যক চিকিৎসক যখন বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সেবা নিশ্চিত করতে চান, তখন আদৌ কতটা সময় দেওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্নও উত্থাপনের সময় এসেছে। তা না-হলে আগামীতে রোগী ও চিকিৎসকের মাঝে সৃষ্ট টানাপড়েন আরও বেশি করে আদালতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
ভিনদেশে চিকিৎসা নিয়ে উচ্ছ্বাসের জায়গা
চিকিৎসক আমার কাছে জানতে চাইলেন— আমার কী কী সমস্যা। এরপর তিনি কিছু টেস্ট লিখে দিলেন। কোন টেস্টটি কিসের, কীভাবে সেই টেস্ট হয়, সেই বিষয়েও আমাকে জানিয়ে দিলেন। যখন যে টেস্ট করতে গেলাম, সেখানেও আমার প্রাইভেসি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন চিকিৎসক ও নার্স উভয়েই। আমি নার্সের সামনে কথা বলতে চাই কিনা, সেটাও জিজ্ঞেস করে নেওয়া হলো। অসুস্থ শরীরেও আমি ভাবছিলাম— এই সম্মানটুকুর জন্য দেশ ছেড়ে এতদূরে এসেছি। এ কথাগুলো বলছিলেন সম্প্রতি ভিনদেশে চিকিৎসা নিয়ে ফেরা একজন বেসরকারি কর্মকর্তা। তিনি দীর্ঘদিন পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। তার অভিযোগ, দেশে তিনি একের পর এক চিকিৎসকের কাছে গেছেন। কিন্তু কী হয়েছে এটা কেউ বুঝিয়ে না বলে ওষুধ দিয়ে গেছেন। আর যেকোনও টেস্ট করাতে গেলে যে পরিবেশের মধ্য দিয়ে শ্যাম্পল দিতে হয়, সেটা খুব লজ্জারও।
সবার তো দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেক্ষেত্রে করণীয় কী, জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বাংরা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। কিন্তু রোগী ও চিকিৎসক উভয়কে সহনশীল আচরণ করতে হবে। যে কয়জন রোগী দেখছেন, চাইলে তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া যায়। অসুস্থ অবস্থায় মানুষ একটু মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। সেটা নিয়ে চিকিৎসদের আলাদা প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
সেবা নিতে গিয়ে রোগীর কী কী অধিকার রয়েছে?
বিশ্বের যেকোনও দেশে রোগীর প্রধান অধিকার হচ্ছে— চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তির অধিকার। অর্থাৎ তাকে কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, কার কাছ থেকে নিচ্ছেন, কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বা হবে, কোনটা করলে কী সমস্যা হতে পারে, শারীরিক কোনও অসুবিধা হতে পারে কিনা, এমনকি মানসিক কোনও সমস্যা হতে পারে কিনা— প্রতিটি তথ্য রোগী বা তাদের স্বজনদের জানার অধিকার রয়েছে। সেবা পাওয়ার সময় তার যদি কোনো ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে, সেটাও তাকে অবশ্যই আগে থেকে অবহিত করতে হবে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘একটি জাতিকে সামগ্রিকভাবে শিক্ষিত হতে হয়। একজন চিকিৎসক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত হবেন, আর যিনি চিকিৎসা নেবেন, তিনিও নেওয়ার মতো উপযুক্ত হবেন। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট ব্যাপারটা যুক্ত করি না। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখেন। যেটা লেখেন সেটা রোগীর জন্য না, ফার্মাসিস্টের জন্য। যে ফার্মাসিস্ট ওষুধ দেবেন, খাওয়ার বিষয়ে তিনি রোগীকে জানাবেন। বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টের রোল ঐতিহ্যগতভাবে গড়ে ওঠেনি। রোগী মনে করেন— ডাক্তারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া, ডাক্তার মনে করেন— যিনি ওষুধ দেবেন তিনি বলবেন। মাঝখান থেকে কোনোটাই হয় না।’
ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করেন, আমাদের দেশে জাতিগতভাবে চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে পারস্পরিক অবিশ্বাস রয়েছে। ডাক্তারের কাছে না গিয়েও উপায় নেই। আবার ঠিকমতো চিকিৎসা হলো কিনা, সেটা নিয়েও দ্বিধায় থাকেন রোগী ও তার স্বজনরা। পারস্পরিক এই আচরণগত জায়গায় কাজ হয় না। রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে যারা সেবা দেওয়া ও নেওয়ার কাজ করছে, তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ দরকার। এটা না হলে এই অবিশ্বাস বহমান থাকবে।’
চিকিৎসা নিতে আসলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে চিকিৎসক ও নার্স— যেই হোক, রোগী বা তার অ্যাটেন্ডডেন্টের যদি কোনও প্রশ্ন থাকে, সেটার উত্তর তাকে দিতে হবে। সেটা অবশ্যই তাদের নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান ড. লেলিন চৌধুরী।
বাংলাদেশে রোগীর অধিকার রক্ষায় কী করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রোগীদের অধিকার রক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি স্বতন্ত্র বডি বা সংস্থা থাকা উচিত।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি কোনও হাসপাতাল বা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যদি কারও কোনও অভিযোগ থাকে, সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা থাকা উচিত। চাইলে ভুক্তভোগী বিএমডিসি-তে অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী বা তার স্বজনরা বিষয়টি জানেন না। দ্বিতীয়ত, আবার তারা জানলেও স্বস্তি বোধ করেন না। কারণ, প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে তাদের কনফিডেন্স নেই।’