মঙ্গলবার | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাত বছর ঝুলে আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ।

সাত বছর ঝুলে আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ। বিদ্যমান আইন যুগোপযোগিতা হারানোর কারণে ২০১৫ সালে এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। একাধিক কমিটি আইনের খসড়া তৈরি করে দিলেও রহস্যজনক কারণে সেই আইন আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গণ্ডি পার হতে পারছে না। সর্বশেষ খসড়াটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেটি ফাইলবন্দি হয়ে আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত আইন পাশ হলে দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা দূর হবে। বিষয়টি আইনের সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তার অংশেও উল্লেখ আছে। এতে বেশকিছু কঠোর বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা বা বোর্ড অব ট্রাস্টিজে (বিওটি) এক-তৃতীয়াংশ সদস্য শিক্ষাবিদ রাখা, উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগে যোগ্যতা পুনর্র্নিধারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ক্ষমতা বাড়ানো ও বিওটির ক্ষমাতা কামানো।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিওটির সদস্যদের পরিবারের কারও লাভজনক পদে থাকায় বিধিনিষেধ, সরকার কর্তৃক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা যুক্ত করা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে পড়ানোর কোটা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের টিউশনসহ অন্য ফি কাঠামো তৈরি ও অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে এফডিআরে টাকার অঙ্ক ও অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ভবনের আকার বৃদ্ধিসহ বেশকিছু যুগান্তকারী প্রস্তাব রয়েছে।

তবে এসব প্রস্তাবের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিওটির আপত্তি আছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত। সবমিলে আইনের খসড়া প্রস্তুত থাকলেও তার চূড়ান্ত অনুমোদনের বৈঠকটি হচ্ছে না। ফলে সংশোধনী সংসদে পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু ইউসুফ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কমিটি প্রণীত খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে ইউজিসি। এখন মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন হলে মন্ত্রিসভার সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো সম্ভব হবে। তবে একাধিকবার এ সংক্রান্ত বৈঠক ডাকার পরও অন্য জরুরি কাজের কারণে তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবহিত আছেন।’

দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ শুরু হয় ১৯৯২ সালের আইনের মাধ্যমে। এটি সংশোধন করা হয় ২০১০ সালে। ৫ বছরের মাথায় এই আইনও যুগোপযোগিতা হারায়। পরে ২০১৫ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে এ আইন আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ওই বছর অক্টোবরে সংসদ-সদস্য আব্দুল কুদ্দুসকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটির গঠন করা হয়েছিল। এতে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রতিনিধি ছিলেন।

ওই কমিটি প্রতিবেদন ঘোরতর বিরোধিতার মুখে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যদের একটি বড় অংশের। যে কারণে সংশোধনী ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৭ মে সংসদীয় কমিটির ২৭তম বৈঠকে সংশোধনীর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (মালিক) সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুনানি করা হয়। এতে সমিতির চার সদস্য যোগ দেন এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধারার ওপর আনা সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। এ অবস্থায় কার্যক্রম আর এগোয়নি।

এরপর এ আইন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা প্রতিবেদন দেয়। সেটিও এখন ফাইলবন্দি।

কমিটিতে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। তিনি যুগান্তরকে জানান, আইনের খসড়া বহু আগে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরপর এটির ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা তারা জানেন না। তবে আইনটি হুবহু পাশ হলে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর হবে। এতে সার্বিকভাবে দেশ লাভবান হবে।

জানা যায়, আইনের খসড়াটি মোট ২২ পৃষ্ঠার। এতে ৩১টি ধারা আছে। তবে খসড়া ও পুরোনো আইনের তুলনামূলক বিবরণীসহ ৪৪ পৃষ্ঠার ফর্দ পাঠিয়েছে ইউজিসি। এতে সংশোধনের ‘উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতি’ আছে। এতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, একাডেমিক, আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম এবং আইন অমান্যের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এটা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুষ্ঠু তদারকি, সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালর কর্তৃপক্ষ, কমিটি এবং ইউজিসিকে আরও ক্ষমতায়ন এবং আইনের কঠোর ও দ্রত প্রয়োগের প্রয়োজনে এই আইন সংশোধন ও সময়োপযোগী করা প্রয়োজন।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ৫ জুন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক বৈষম্য আছে। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধনের ব্যাপারে কথা বলছি। কাজও করছি।’

আইনের সংশোধনী প্রসঙ্গে আলাপকালে সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, উচ্চশিক্ষার স্বার্থে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দরকার আছে। কিন্তু আইনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে সরকারি আর বেসরকারির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আর যদি তাই হয়, তাহলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়েও সরকারের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

কী আছে খসড়ায় : খসড়ায় মোটা দাগে আরও আছে-প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ডে কমিশন বা সরকারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে একজন পর্যবেক্ষক মনোনয়ন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সংরক্ষিত তহবিলে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ন্যূনতম আট কোটি, অন্য মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য পাঁচ কোটি এবং এর বাইরে হলে তিন কোটি টাকা ইউজিসি নির্ধারিত তফশিলি ব্যাংকে সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত অবস্থায় জমা রাখতে হবে।

এই অর্থ ও এর লাভ কমিশনের সুপারিশক্রমে অনুমোদন নিয়ে তোলা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কমপক্ষে পাঁচ একর নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকতে হবে। বিওটির কোনো সদস্য বা তার পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সভা বা কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা নেবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মূল সনদে উপাচার্য এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের যৌথভাবে স্বাক্ষর সিলমোহর থাকতে হবে।

দেশের আর্থসামজিক অবস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষার্থী ফি কাঠামো করতে হবে, যাতে কমিশনের অনুমোদন লাগবে। সেটি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে। শিক্ষার্থী কোনো প্রোগ্রামে ভর্তির সময় যে ফি কাঠামোয় ভর্তি হবে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বাড়ানো যাবে না।

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী বেতন কাঠামো ও চাকরি প্রবিধানমালা প্রস্তুত করে তা কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে। আইনের কোনো বিধান বা নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১১টি। আরও অন্তত দুই ডজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জমা আছে।

 

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.