রবিবার | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাড়ির অত্যাধিক হর্নে শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে সাধারণ মানুষসহ শিশুরা

প্রিয় রাজশাহী ডেস্কঃ মেধাবী শিক্ষার্থী আফসারা নূর। সপ্তম শ্রেণিতে রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে ভর্তি করান অভিভাবকরা। পরিবারের ইচ্ছে, আগে থেকেই রাজধানীতে পড়তে আসুক আফসারা। কিন্তু আফসারার গত এক বছরে শুধু মাথা ব্যথা, বিষণ্ণতায় আর সুস্থতার কারণে তাকে আবার গ্রামে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন অভিভাবকরা।

তারা বলছেন, চিকিৎসক বলেছেন অতিরিক্ত শব্দ আর রাজধানীর দূষিত আবহাওয়ায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। ফলে তার মাথা ব্যথা ও বিষণ্ণতা দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা সে গ্রামে গেলে আর থাকে না বলে জানান মেয়েটির অভিভাবক।

অর্পা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোস্টেলে উঠেছেন। ভর্তি পরীক্ষার জন্য পরিশ্রম করছেন দিনরাত। অথচ গাড়ির শব্দে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছেন না একদমই। যা পড়ে সবই ভুলে যাচ্ছে মেয়েটি। কেন সে মনে রাখতে পারছেন না সে নিয়েই এখন সে অস্থির। গাড়ির এত বিকট শব্দ, তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিকমতো রাতে ঘুমাতে পারে না মেয়েটি, এ নিয়ে সবার সঙ্গে খিটমিটে আচরণ করে।

আফসারা, অর্পার নীরব এলাকা গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে হঠাৎ এত শব্দের মধ্যে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না। শুধু যে আফসারা ও অর্পার এ অবস্থা তাই নয়, এমন অবস্থা রাজধানীর অর্ধেক মানুষের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিতভাবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা একটি বধির জাতিতে পরিণত হব। আমরা একদিকে যেমন একটি বধির প্রজন্মের দিকে ধাবিত হচ্ছি তেমনি প্রাণিকুলও ধ্বংস করছি। এ বিষয়ে সচেতনা বাড়াতে হবে। রাজধানী ঢাকা শহরের ১৭টি নীরব এলাকা হাসপাতালের সামনের সড়কের শব্দ দূষণের মাত্রা নির্ণয় করে দেখা গেছে, সেখানে সর্বনিম্ন ৬৯.৭ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ৮৯.৯ ডেসিবল। যেখানে নীরব এলাকার জন্য শব্দের আদর্শ মান দিনের বেলায় থাকার কথা ৫০ ডেসিবল।

গাড়ির শব্দে বিরক্ত রাজধানীবাসীও। অত্যধিক গাড়ির হর্নের শব্দে বধির হওয়ার পথে সাধারণ মানুষ। বাদ যাচ্ছে না ছোট্ট শিশুরাও। রাস্তায় চলতে ফিরতে অযথা হর্ন বাজায় অনেকে। কেউ তো আবার হর্ন চেপে ধরে রাখে দীর্ঘক্ষণ। হর্ন বাজানো যেন ছেলেখেলা! এই খেলা যে অনেকের জীবনে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, তা হয়তো হর্ণ ব্যবহারকারীরা জানেনও না।

ছোট্ট শিশুরা প্রতিদিন সকাল হলেই স্কুলে ছুটছে। এদিকে স্কুলের সামনে দিয়ে চলা যানবাহন জ্যামে বসে হাইড্রোলিক হর্ন বাজাতে থাকে। এতে যেমন পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে তেমনি শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে শিশুরা। হর্ন ধীরে বাজানোর কথা বললেই তেরে আসছে কেউ কেউ। হর্ন বাজানো বন্ধ হচ্ছে না হাসপাতালের সামনের রাস্তায়ও! রিকশার টিংটিং শব্দ কিংবা গাড়ির শব্দ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাজিয়ে চলেছে অনেকে। অসুস্থ রোগীর কথা ভাবছে না তারা। তাদের শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া।

শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ ট্রাফিক পুলিশ। দিন-রাত রাস্তার যানজট নিয়ন্ত্রণে তারা নিরলস পরিশ্রম করছেন। যানজটের সড়কে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত গাড়ির শব্দ সহ্য করা চারটি খানি কথা নয়। অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন, প্রাইভেট গাড়ির হর্ন, বাসের হর্ন, বেপরোয়া মোটরসাইকেলের হর্ন যে কারো শ্রবণশক্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।

উড়োজাহাজ কিংবা ফাইটার প্লেনের শব্দে ঘুম থেকে আঁতকে উঠছে দুধের শিশুরা। বেপরোয়া হর্নের শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্রের প্রাণীরাও। সমুদ্রের জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দে বিরূপ আচরণ করছে বিশালাকৃতির তিমি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।

অতিরিক্ত শব্দের ভেতর থাকলে হাইপার টেনশন, হূদেরাগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি কমা, স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যার মতো কঠিন রোগে ভুগতে হতে পারে। এছাড়া ১২০ ডেসিবল শব্দ আপনার কান নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাই শব্দদূষণের ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শব্দদূষণ রোধে সবার আগে জরুরি অত্যাধুনিক হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা। এছাড়া স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালকে নীরব এলাকা ঘোষণার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।

এদিকে রাতে ঘুমানোর সময় উচ্চস্বরে সাউন্ডবক্স বা মাইক বাজানোকে না বলতে হবে। নির্মাণকাজে যতটা কম শব্দ করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া সামাজিক সচেতনতা, ব্যক্তি সচেতনতা ও সরকারের শক্ত পদক্ষেপ পারে শব্দদূষণ রোধ করতে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক অবসাদসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষত, শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে কারণ তাদের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব স্থায়ী হতে পারে। গর্ভবতী নারীরা অতিরিক্ত শব্দদূষণের শিকার হলে সন্তানদের বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয়ে থাকে যানবাহনের অযথা ও অতিরিক্ত হর্নের কারণে। বিশেষত যানজটে আটকে থাকাকালীন গাড়িচালকদের মধ্যে অযথা হর্ন বাজানোর মানসিকতার কারণে নগরবাসী ভয়াবহ শব্দদূষণের শিকার হন।

ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমএ মান্নান মনির বলেন, আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষত অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকার জন্য গাড়িচালকদের সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। কারণ গাড়িচালকের বাজানো হর্নের কারণে তিনি নিজে, তার সন্তান, আত্মীয়স্বজন সকলেই শব্দদূষণের ভয়াবহতার শিকার হচ্ছেন। সূত্রঃ ইত্তেফাক।

প্রি-রা/শা

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.