বুধবার | ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কুষ্টিয়াকে বলা হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী। একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি অন্যদিকে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের আখড়া। লালনের সৃষ্টি সবাইকে টানে। যেমনি টেনেছিল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানেই বাউল সুর নেওয়া হয়েছে। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের অনেককেই মোহিত করেছিল লালন সঙ্গীত।

লালন আখড়ায় যাওয়ার ইচ্ছাটা দীর্ঘদিনের। কিন্তু সময়-সুযোগের মিলন ঘটছিলো না। তাই হুট করেই কুষ্টিয়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। উদ্দেশ্য বেড়ানো। কারণ ছেউড়িয়ায় লালন মেলা চলছে। এ সুযোগটাতো হাতছাড়া করা যাবে না।

দীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘণ্টার জার্নি শেষে পৌঁছলাম গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম সারি সারি রিক্সা। ডাকছে-লালন মেলা, লালন মেলা।একটি রিক্সায় চড়ে বসলাম। শুরু হলো যাত্রা।
প্রায় ১০ মিনিটের পথ। রিক্সা গিয়ে থামলো ছেউরিয়ায় লালন আখড়া থেকে বেশ কিছু দূরে। চালক জানালো আর যাওয়া যাচ্ছে না। নামতে হবে। ভাড়া চুকিয়ে নেমে গেলাম।

হেঁটেই ঢুকলাম মেলা প্রান্তরে। মূল গেইট থেকে মাঠ পর্যন্ত পাকা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে দোকানীরা বসেছে পণ্যের পসরা সাজিয়ে। বেশির ভাগই খাবারের দোকান। গজা, মিষ্টি, চটপটি। রয়েছে ফার্নিচারের দোকানও। ক্যাসেট-সিডির দোকানে বিক্রি হচ্ছে লালনের গানের সিডি। আছে বইয়ের স্টলও।

মাঠের বাম দিকে লালনের মাজার। মাজারের পথটা অনেক সুন্দর। পথের দুই পাশে বাদ্যযন্ত্রের স্থায়ী দোকান। দোকানগুলোতে সাজানো আছে নানা ধরনের বাদ্য যন্ত্র। বেশির ভাগ দোকানেই একতারা, দোতারা, বাঁশি, লালনের স্ট্যাচু, শো-পিস আর আর সব নাম না জানা বাদ্যযন্ত্র। সবই দেশিও ঐতিহ্যাবাহী যন্ত্র।

আছে কিছু খাবারের দোকানও। এরপর আছে আরেকটি গেট। এটি মাজারের মূল গেট। মূল গেটের ভেতরে ঢুকে অল্প একটু এগুলেই মূল মাজার ভবন। এর ভেতর লালন সমাধী।

লালন সমাধীর পাশে তার পালক মাতার কবর। বাইরে রয়েছে লালন সাইর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ ও অন্য শিষ্যদের সমাধী।

মাজারের পর লালন কমপ্লেক্স’র ভবন। এখানে রয়েছে পাঠাগার, রিসোর্স সেন্টার আর অডিটোরিয়াম। বামদিকে নীচতলায় লালন যাদুঘর। দুই টাকার টিকিট নিয়ে জাদুঘরে ঢোকা যায়। লালনের ব্যবহৃত অনেক কিছু রয়েছে সেখানে। রয়েছে তার একতারাও।

অডিটোরিয়ামের নিচে হারমোনিয়াম, তবলা, দোতারা নিয়ে দলে দলে সাধুরা গান গাইছেন। জাদুঘরের একটু দূরে দেখলাম দুই সাধু বসে আছেন। সাদা পোশাক, সাদা দাড়ি। এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম তাদের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তাদের একজন জানালেন-লালন ভক্তরা অডিটোরিয়ামে ওঠেন না। কেন ওঠেন না? এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আমার গুরু নিচে চিরশায়িত আর আমি তার উপরে উঠব, এটা কী হয়? বিমোহিত হলাম তার গুরু ভক্তি দেখে।

এরপর সাধু গান ধরলেন, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা করে ত্বরাই করো এই ভবে…’ কিছুক্ষণ তার গান শুনে এগিয়ে যাই মাঠের দিকে। দেখলাম দেশ-বিদেশ থেকে আগত হাজারো ভক্তের আগমনে মুখরিত লালন আখড়া।

মাজার এলাকা থেকে বেরিয়ে গেলাম মাঠের দিকে। মাঠে মূল অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে প্যান্ডেল। ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম আধুনিক স্টেজ। মুখরিত হচ্ছে সাইজীর গানে। ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, সেথা এক পড়শি বসত করে…’। ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে…’।

আধ্যাত্মিক সাধক লালন শাহর কুষ্টিয়া শহর থেকে সামান্য দুরে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে আশ্রয় লাভ করেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ভোর পাঁচটার সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা ১২৯৭ সাল। মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি স্থলেই আখড়া গড়ে ওঠে।

১৯৬৩ সালে সেখানে তার বর্তমান মাজারটি নির্মাণ করা হয় এবং তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। ২০০৪ সালে সেখানেই আধুনিক মানের অডিটোরিয়ামসহ একাডেমি ভবন নির্মাণ করা হয়। ফকির লালন শাহের শিষ্য এবং দেশ বিদেশের অগনিত বাউলকুল এই আখড়াতেই বিশেষ তিথিতে সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে উঠেন।

এই মরমী লোককবি নিরক্ষর হয়েও অসংখ্য লোক সংগীত রচনা করেছেন। বাউল দর্শন এখন কেবল দেশে নয়, বিদেশের ভাবুকদেরও কৌতুহলের উদ্রেক করেছে। লালন নেই, আছে তার স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু লালন কি আসলেই নেই? ইহজগতে না থাকুক, লালন আছে।

প্রি/রা/শা

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.