বছরের পর বছর আন্তঃনগর ট্রেনে রংপুর-ঢাকা যাওয়া-আসা করেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বাসিন্দা সিরাজ মিয়া। রাজধানীতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তার মতো অনেকেই রাজধানীতে আসেন কাজের সন্ধানে। তাদের কারও মোবাইল আছে, কারও নেই। যাদের আছে তা আবার বাটন মোবাইল। স্মার্ট সেট ব্যবহারের সামর্থ্য তাদের নেই। নেট দুনিয়া সম্পর্কেও ধারণা নেই তাদের। এসব মানুষের জন্য আন্তঃনগর ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটা তাদের কাছে এখন স্বপ্ন। কারণ ট্রেনের শত ভাগ টিকিট এখন বিক্রি হয় অনলাইনে। গত ঈদুল ফিতরের মতো এবারের ঈদুল আজহায় অনলাইনে টিকিটি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ যাত্রী তথা প্রান্তিক মানুষ অনলাইনে টিকিট কিনতে পারছেন না। আন্তঃনগর ট্রেন এখন তাদের জন্য; যাদের স্মার্টফোন আছে, যারা ইন্টারনেটে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। অর্থাৎ শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর সুবিধাভোগী মানুষের জন্যই এখন আন্তঃনগর ট্রেন।
তবে রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, আধুনিকতার সঙ্গে তালমেলাতে রেলের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ যাত্রী কিংবা সুবিধাবঞ্চিত মানুষ হয়তো আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবে না। তবে তাদের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্টেশনে হেল্প ডেক্স বসানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা গত ঈদে সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করেছি। কেউ পাচ্ছেন-কেউ পাচ্ছেন না। তবে যারা নতুন এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারছেন না কিংবা স্মার্টফোন নেই-তাদের জন্য মেইল, লোকাল, কমিউটার ট্রেন রয়েছে। রেলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা বাড়ছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য আন্তঃনগর ট্রেন ব্যবহার নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে।’
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে টিকিটের জন্য কমলাপুর, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসহ দেশের প্রধান প্রধান স্টেশনগুলোতে ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়ায় এমন দৃশ্য যে চোখে পড়ছে না, তা কিন্তু নয়। প্রতিদিনই কমলাপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনে শত শত মানুষ কাউন্টারে আসছেন টিকিট কাটতে। আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় তারা সাধারণ ট্রেনে ভ্রমণের চেষ্টা করছেন। আবার সাধারণ ট্রেনের টিকিটও কাটতে পারছেন না অনেক মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে কমসংখ্যক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। স্মার্টফোন ব্যবহার করেন ৩২ শতাংশ মানুষ। আর সমগ্র বাংলাদেশে ৩৮.৯ শতাংশ ইন্টারনেট এবং ৩১ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
খুলনাগামী যাত্রী আব্দুল রহিম জানান, একসময় স্টেশন কাউন্টার থেকে টিকিট পাওয়া যেত। এখন কোথায় টিকিট কাটা হয়, কোথায় পাওয়া যায়; জানি না। স্মার্টফোন নেই। অনলাইন সম্পর্কে কিছু বুঝি না। কিভাবে টিকিট পাব। তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় আন্তঃনগর ট্রেনে গ্রামে যেতাম। ওটায় একটা আনন্দ আছে। এখন সেই আনন্দ নেই। আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য আন্তঃনগর ট্রেন এখন শুধুই স্বপ্ন। এখন ট্রেন দেখে আফসোস করি। কারণ টিকিট কাটতে পারি না।’ চট্টগ্রামগামী যাত্রী বিল্লাল হোসেন জানান, সব জায়গায় বৈষম্য। রেলেও তাই। আন্তঃনগর ট্রেন, লোকাল-মেইল, কমিউটার ট্রেন-এখন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হয়ে গেছে। এখন নিম্ন আয়ের মানুষ আন্তঃনগর ট্রেন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সড়কপথের চেয়ে রেলপথে (আন্তঃনগর ট্রেনে) ভাড়া কম। ফলে সাধারণ, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ আন্তঃনগর ট্রেনে চড়তেন। কিন্তু এখন পারছেন না।
এ ব্যাপারে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সফিকুর রহমান বলেন, মানুষ খুব সহজেই অনলাইন থেকে টিকিট কাটতে পারছেন। যাদের সক্ষমতা নেই, তারা হয়তো অনলাইন ব্যবহার করতে পারছেন না। আমরা ওই সব মানুষের জন্য ২৫ শতাংশ আসনবিহীন টিকিট দিচ্ছি-শুধুমাত্র যাত্রার দিন। এখন শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। এতে আয় বাড়ছে। বাড়ছে নিরাপত্তা ও সেবা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রেল কর্মকর্তা জানান, ঈদে আন্তঃনগর ট্রেনেও বিনাটিকিটে যাত্রী ভ্রমণ করেন। বিশেষ করে ঈদের তিন দিন আগ থেকে প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে আসন সংখ্যার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী চড়েন। ছাদে ওঠা নিষেধ থাকলেও মানছেন না সাধারণ মানুষ। এসব মানুষের অনেকেই কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতেন। এখন টিকিট কাটতে না পারায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েন তারা।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ যাত্রী কিংবা যাদের স্মার্টফোন নেই তারাও আন্তঃনগর ট্রেনে চড়তে চান। স্টেশনে এসে ভিড় করেন তারা। টিকিট না মেলায় সুযোগ বুঝে বিভিন্ন ট্রেনে ওঠে পড়েন কেউ কেউ। স্মার্টফোন নেই এমন যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যক টিকিট কাউন্টার থেকে দেওয়া হলে এই বৈষম্যটা হতো না।
এদিকে রেলওয়ে বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হওয়ায় রেলে আয় বাড়ছে। টিকিট কালোবাজারি বন্ধ হয়েছে। দিনের পর দিন স্টেশনে টিকিট প্রত্যাশীদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। এখন যারা অনলাইনে টিকিট কাটতে পারছেন না, তারা বিকল্প ব্যবস্থায় গ্রামে যাচ্ছেন। কারণ ঈদযাত্রায় ট্রেনের অগ্রিম টিকিট ১০ দিন আগে ছাড়া হচ্ছে।
ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির জানান, ঈদ উপলক্ষ্যে ঢাকা থেকে মোট ৩৮ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করবে। এছাড়া তিন জোড়া ঈদ স্পেশাল ট্রেন যুক্ত হবে। প্রতিদিন প্রায় ২৯ হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ কিংবা স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন না, এমন মানুষের জন্য শুধুমাত্র যাত্রার দিন ২৫ শতাংশ আসনবিহীন টিকিট কাউন্টার থেকে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু, আসনবিহীন টিকিট স্মার্টফোন যাদের নেই-তারা কাটতে পারছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। ওই টিকিটগুলো সবার জন্য।
রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান বলেন, দুনিয়া এখন আধুনিক হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে। লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন আরও বাড়বে। ফলে স্মার্টফোন কিংবা অনলাইন ব্যবহার না জানা সাধারণ যাত্রীরাও টিকিট পাবেন।