মঙ্গলবার | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজশাহীতে জোড়া ফাঁসির সময় মাটিতে পড়ে যান কারাগারের জেল সুপার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জোড়া ফাঁসি কার্যকরের পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিলের। এর আগে বিভিন্ন সময়ে তিনজন আসামির ফাঁসি কার্যকরে দায়িত্ব পালন করেছেন; কিন্তু রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে স্মরণকালের ইতিহাসে একই মঞ্চে একসঙ্গে দুই আসামির ফাঁসির ঘটনাও এটাই প্রথম।

কারাবিধি অনুযায়ী সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল আগে থেকেই। প্রধান জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চে হাতল ধরে নির্দেশের অপেক্ষায় তাকিয়ে ছিলেন সিনিয়র জেল সুপারের দিকে। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা বেজে ১ মিনিট ছুঁতেই সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল হাতে থাকা কালো রুমালটি নিচে ফেলে দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ আলমগীর হোসেন টান দেন ফাঁসিকাষ্ঠের হাতলে। দৃশ্য দেখে তখনই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যান সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল। হৃদরোগের সমস্যা থাকায় তিনি এ দৃশ্য দেখতে পারছিলেন না। পরে উপস্থিত কর্মকর্তা দলের চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত অন্য স্থানে নিয়ে চিকিৎসা দেন।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মহিউদ্দিন এবং জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের শেষ দেড় ঘণ্টায় কী ঘটেছিল তার বর্ণনা পাওয়া গেছে উপস্থিত বিভিন্নজনের কাছে।

ফাঁসি কার্যকরের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ১৬ সদস্যের একটি টিম। তাদেরই একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই রাতে ফাঁসি কার্যকরের সময় ঘটা কিছু ঘটনার বিবরণ দেন একদিন পর শুক্রবার।

তিনি জানিয়েছেন, ফাঁসি কার্যকর করা হবে রাত ১০টা ১ মিনিটে। ফাঁসি কার্যকরের ৬ মিনিট আগে রাত তখন ৯টা বেজে ৫৫ মিনিট। অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলায় ১৫ বছর ধরে কারাগারে থাকা মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকরে তোড়জোড় চলছে তখন। কনডেমড সেলের ১০ নম্বরে মহিউদ্দিন ও ১৪ নম্বর কনডেম সেলে ছিলেন জাহাঙ্গীর। দুই আসামিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারারক্ষীর সহায়তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত জল্লাদরা সেল থেকে তাদের নিয়ে আসেন।

এ সময় মহিউদ্দিন এবং জাহাঙ্গীরকে দুটি আলাদা হুইলচেয়ারে বসিয়ে ধীরে ধীরে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে আসা হয়। সেল থেকে বের করার আগেই তাদের মাথায় কালো মোটা কাপড়ের জম টুপি পরানো হয়; যাতে আশপাশে কি আছে তারা দেখতে না পারেন। হুইলচেয়ারে বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই নরম কিন্তু মজবুত রশি দিয়ে বাঁধা হয় হাত ও পা। ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত তাদের হাত বাঁধা থাকে সামনের দিকে। স্বল্প দূরত্বের এই পথে আসার সময় তাদের আস্তে আস্তে দোয়া পড়তে শোনা যায়।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, রাত তখন ৯টা বেজে ৫৭ মিনিট। জল্লাদরা হুইলচেয়ার ছেড়ে তাদের দুজনকে ফাঁসির মঞ্চে তোলেন। এরপর হুক রয়েছে এমন দুটি পাটাতনের ওপর দাঁড় করায় সোজাভাবে। হাত দুটি সামনে থেকে পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাপ পরানো হয়। মহিউদ্দিনের বামে দাঁড় করানো হয় জাহাঙ্গীরকে। মাথায় জম টুপির ওপর দিয়ে দুজনের গলায় পরানো হয় রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা বিশেষ ধরনের ফাঁসির দড়ি। সময় তখন ৯টা ৫৯ মিনিট। দেড় মিনিটেরও কিছু বেশি সময় একেবারে পিনপতন নীরবতা। অবশ্য চারপাশ তখন উঁচু করে কালো পর্দায় ঢাকা।

হুইলচেয়ারে বসিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, যদি আসামি ছোটাছুটি করে কিংবা ছটফট করে, সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। সেলের বাইরে সে কিছুই দেখতেও পাবে না, হাত ও পা বাঁধা থাকবে।

তিনি আরও জানান, রাত ১০টা বেজে ৩০ সেকেন্ড। কর্মকর্তারা মঞ্চের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল হাতে কালো রুমাল নিয়ে তা ফেলতে উদ্যত। ফাঁসির মঞ্চের নিচে এক পাশে তখন ৭ জন জল্লাদ অবস্থান নিয়েছেন। আর মূল হাতল ধরে নির্দেশের অপেক্ষা করছেন প্রধান জল্লাদ আলমগীর। ফাঁসির মঞ্চে তখন মহিউদ্দিন এবং জাহাঙ্গীরের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। যেন সময় থেমে গেছে। দুজনের একজন তখনো দোয়া পড়ছেন।

এদিকে রাত সোয়া ১২টার দিকে ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেন সিনিয়র জেল সুপারের অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সিনিয়র জেল সুপার সাহেব মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ওনার প্রেশার বেশি ছিল।

তবে সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল বলেন, আমার আগে থেকেই প্রেশারের সমস্যা, তাই আমি এডিএমকে বলেছিলাম, কালো রুমাল হাত থেকে ফেলার পর আর আমি সেখানে থাকব না। তিনি অনুমতি দিয়েছেন। আমি রুমাল ফেলেই দূরে সরে এসেছিলাম। আর আমার চাকরি জীবনে এবারই প্রথম জোড়া ফাঁসি কার্যকর করলাম।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ নিখোঁজ হন। ৩ ফেব্রুয়ারি বাসার পেছনে ম্যানহোল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০০৮ সালে মামলার রায়ে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে শেষপর্যন্ত দুইজনের সাজা কমে যাবজ্জীবন হলেও মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের সাজা বহাল থাকে। ২৭ জুলাই রাতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁকি কার্যকর করা হয়। সূত্রঃ যুগান্তর।

প্রি/রা/শা

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.