বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘বই থাকলে সভ্যতা থাকবে। আর বই না থাকলে সভ্যতাও থাকবে না।’ শনিবার বিকেলে রাজশাহীতে বই বিক্রেতা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বাতিঘর’ এর ষষ্ঠ আউটলেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বই হচ্ছে রুচি। মানুষের সভ্যতার সৃষ্টি করেছে বই। যদি বই থাকে, তো সভ্যতা থাকবে। আর যদি বই চলে যায়, তাহলে সভ্যতা চলে যাবে পৃথিবী থেকে। আবার সেই জন্তু-জানোয়ারের সাথে বসবাসের যুগ আসবে একদিন। বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৫ হাজার স্কুলে এখন বুক রিডিং প্রোগ্রাম চলছে। আর তিনমাস পরে এটা ৩০ হাজার হবে। প্রত্যেকটা স্কুলে বুক রিডিং প্রোগ্রাম থাকবে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর চেষ্টা সারা বাংলাদেশে করেছি। তারপর ভ্রাম্যমাণ বইমেলা এবং সেটাকেও এখন আমরা বড় করব আরও। প্রত্যেক জায়গায় বইমেলা হবে। এটা আমাদের করতে হবে।
বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমাদের সমস্ত জাতির বই একটামাত্র মেলায় এসে জমা হয়। সেটা কোনটা? একুশের বইমেলা। এটা দিয়ে কি একটা জাতি চলতে পারে? একটা শহর, একটা গ্রাম চলতে পারে। একটা জাতির কি একটা জায়গায় মেলা দিয়ে চলতে পারে? চলতে পারে না। প্রত্যেক জায়গায় মেলা হতে হবে। গভমেন্ট একটা চেষ্টা মাঝেমধ্যে করে, কিন্তু সাকসেসফুল হয় না। কারণ, পাবলিশাররা আসতে পারেন না এত দূরে এত টাকা খরচ করে। এটা সম্ভব হয় না। ঢাকার বাইরে বইমেলা করে টাকা ওঠে না।
স্কুলে স্কুলে বইপড়া কমে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘এরশাদ সরকার আসার পরে একটা কমিটি গঠিত হলো। কর্নেল এনাম কমিটি। সেই কমিটি এসে কি করল? মানে আমাদের শেষপর্যন্ত যা আশা-ভরাস ছিল, উনি সেটাকে শেষ করে দিলেন। উনি দেশের সমস্ত স্কুল থেকে লাইব্রেরিয়ানের পদ বিলুপ্ত করে দিলেন। এখন স্কুলে আর বই নাই। স্কুলে বই নাই মানে কি? ছাত্রের কাছে বই নাই মানে কি? সারা জাতির কাছে বই নাই। তারপরও ছেলেপেলেরা যেন বই কাকে বলে তা চোখে দেখতে না পারে সেই জন্য বইগুলোকে সব ঢোকানো হলো কাঠের আলমারির মধ্যে। লোহা-কাঠের আলমারি এবং সামনে বাজারের সবচেয়ে ভয়াবহতম তালা এনে লাগানো হলো। স্কুলের মধ্যে যে শিক্ষক সবচেয়ে ভয়াবহ দর্শন, যাকে দেখলে ছাত্ররা দৌড় দেয় তাকে লাইব্রেরিয়ানের ভারপ্রাপ্ত করা হলো। বই দেওয়া হবে না, কিন্তু বইগুলোকে তো রাখতে হবে।
এরপর আস্তে আস্তে লাইব্রেরী শেষ হয়ে গেল। শিক্ষা আরও নিচের দিকে নামলো। তখন আমরা এই এরশাদ আমলের শেষদিকে বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র করার কথা চিন্তা করলাম যেহেতু একটা জাতি বইহীন হয়ে গেছে। এখন এই জাতির মধ্যে বই আনতে হবে। ব্রিটিশরা যে রকম আমাদের চা ধরিয়েছিল।
আমরা তেমনি এই জাতিকে বই ধরাব। দেখা যাক, যেমন করে পারি বই আনব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন না ৭ই মার্চের ভাষণে? ভাষণের সময় আমি ঠিক বঙ্গবন্ধুর থেকে ৩০ হাত দূরে ছিলাম। আমি ওই তেজ দেখেছি। মাইক্রোফোন শুনেও বোঝা যায় না। আর ভিডিওতেও বোঝা যায় না। উনি বলেছিলেন যে “যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” আমরা ঠিক করলাম যে যত দিক থেকে পারা যায় এই জাতির হাতে বই নিয়ে যেতে হবে আমাদের। কারণ বই হচ্ছে পরিশীলন।
এ সময় তিনি বাতিঘরের রাজশাহী আউটলেটের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করতে শিক্ষানগরী রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার পেছনে খানসামার চকে এই আউটলেট করা হলো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল এটি। হাজির হয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও।
অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন- লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ, বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ, রাজশাহী নগর পুলিশের কমিশনার আনিসুর রহমান, জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, কবিকুঞ্জের সভাপতি রুহুল আমিন প্রামানিক প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাস।