প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের টাকায় নির্মিত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর পূর্তি হলো আজ। এই এক বছরের ব্যবধানে দেশের শিল্প বাণিজ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে মাদারীপুর জেলায়।
যে জেলার মানুষদের কাজের জন্য যেত হতো রাজধানীতে। তারা এখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হওয়ার ফলে নিজ জেলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছেন।
এইসব কিছুর মূলে রয়েছে পদ্মা বহুমূখী সেতু। জেলায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মিল ও কারখানা যা এ দক্ষিণ অঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বদলে গেছে মাদারীপুরের অর্থনীতির চিত্র। এখানে মিল কারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কারখানা হয়েছে। এ অঞ্চলে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে গবাদি পশুর খামার, হাঁস মুরগির খামার, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, মিল কারখানা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল এবং স্কুল-মাদরাসা নির্মাণ হচ্ছে।
রাজধানী থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে হওয়ায় মাদারীপুরে বিভিন্ন কৃষি বাজারে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফেনী, গোপালগঞ্জ, নাটোর, যশোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ প্রায় সারাদেশের ব্যবসায়ীরা কৃষি পণ্য ক্রয় করতে আসেন।
মাদারীপুরে ধান, পাট, গম, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা, কালোজিরা, তিলসহ আলু, কুমড়া, করলা, বেগুন, কচু, চিচিংগা, ঝিংগা, ডাটা, লালশাক, পুঁইশাক, পেঁপে, শসা, লাউ, টমেটো, পটল, আখ, ডাল, ধনিয়াসহ সব ধরণের কৃষি পণ্য উৎপাদন করে এ অঞ্চলের কৃষকেরা।
এদিকে পদ্মা সেতুর চালুর পর মাদারীপুর জেলা জুড়ে ৮০ থেকে ৯০টির মতো গড়ে উঠেছে রাইচ মিল। ১০ থেকে ২০টির মতো গড়ে উঠেছে কল কারখানা, ১৫০ থেকে ২০০টির মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতালসহ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৩০০ থেকে ৫০০টির মতো গড়ে উঠেছে গরু-ছাগলসহ হাস-মুরগির খামার, ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো হয়েছে নতুন উদ্যোক্তা।
সূর্যনগর বাসিন্দা পারভেজ বলেন, মাদারীপুর জেলা ছাড়াও অন্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা জমি কিনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় এখানে জমির দাম পাঁচগুণ থেকে সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেভাবে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে তাতে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে।এক সময় এই জেলা বাণিজ্যিক জেলায় রুপান্তর হবে।
আনোয়ার অটো রাইচ মিলে মালিক আনোয়ার হোসেন মুফতি বলেন, আমি অনেক বছর ধরে মিল কারখানা ও গবাদি পশুর খামার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি প্রথমে ভয়ে ভয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। আজ পদ্মা সেতুর কারণে আমি ব্যবসায় বড় করতে পারব। তাই রাজৈর উপজেলার রাইচ মিল কারখানা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
এই মিলে ৫০ জনের বেশি কর্মসংস্হানের সুযোগ-সুবিধা হয়েছে। এখন থেকে আমার ব্যবসার একটা বড় অংশ মাদারীপুর শহরে গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করব। এতে জেলার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় ক্ষদ্র ব্যবসায়ীরাও অল্প পুঁজিতে ভালো ব্যবসা করতে পারবেন।
আরেক রাইস মিল মালিক হালিম শিকদার বলেন, পদ্মা সেতুতে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। যেখানে ঢাকা যেতে ৫ ঘণ্টা লাগত সেখানে এখন আমরা দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আমরা চাল বিক্রি করতে পারি।
মোল্লা ফিলিং স্টেশনের মালিকরা জানান, এদিকে পদ্মা সেতু হওয়ায় একাধিক ফিলিং স্টেশন হয়েছে। মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
বিসমিল্লাহ ফোটের মালিক বিসমিল্লাহ এগ্রো ফুডের মালিক বিপ্লব জর্দি বলেন, আগে পণ্য দ্রব্য নিয়ে রাজধানীতে যাতায়াতে অনেক সময় লেগে যেত। এখন আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। আমাদের ব্যবসা সম্প্রচার করতে সুবিধা হবে।
নারী উদ্যোক্তা রিনা বলেন, আগে কাজ কম পেতাম, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অনেক কাজ পাই। এখন আর পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় না। বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করেই কাজ করতে পারছি। বেতন যা পাই, তা দিয়ে সংসার খরচ চলে যায়।
মাদারীপুরের সবজি ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, তার এলাকায় উৎপাদিত সবজি ট্রাকভর্তি করে ঢাকায় পাঠাতে ফেরিতে ৪-৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক সজবি নষ্ট হতো। ট্রাক ভাড়াও বেশি গুণতে হতো।
এখন পদ্মা সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানোর কারণে খরচ কমে গেছে, সবজিও তাজা থাকছে। যেকোনো সময় কাঁচামাল ভর্তি ট্রাক রাজধানীতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে আমার মতো অন্য ব্যবসায়ীরাও লাভবান হয়েছে।
গরুর খামারিরা জানান, এ জেলা থেকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোরবানির গরু নিয়ে রাজধানীর হাটে যেতে আগের মতো কোনো দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। কারণ দিন-রাত যেকোনো সময়েই পদ্মা পার হওয়া যায়।
সবজির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন বাড়াতে পতিত জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ শুরু করছে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ। মানসম্মত ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার কৃষক ও কৃষাণিকে।
মাটির ধরণ অনুযায়ী অনাবাদী জমিতে সবজি উৎপাদনে কাজ শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। এছাড়া নতুন করে চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে ৪ হাজার ৭২০ হেক্টর অনাবাদী জমি। যার ফলে গত রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬৭ কোটি টাকার।
শিবচরে চাষি আনোয়ার বেপারি বলেন, আমি লাউ ও কচু চাষ করেছি। রাজধানীর কাওরান বাজার বিভিন্ন পাইকাররা এসেছে আমার চাষ করা সবজি কিনতে। আমি তাদের কাছে আমার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পেরেছি।
কৃষি পণ্য উৎপাদন, বিক্রিসহ জীবন মানে উন্নয়ন সবকিছুর মূলে এই পদ্মা সেতু। এই সেতু না হলে আমার ভাগ্যচাকা কবে ঘুরত তা বলা মুশকিল ছিল। পদ্মা সেতুর এক বছর পূর্তিতে যা পেয়েছি তাতে আমার ভাগ্যচিত্র পাল্টে গেছে। আশা করছি আগামী দিনে আরও বেশি লাভবান হতে পারব।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইএনও) মাইনউদ্দীন বলেন, সবজি রপ্তানিকে আরও সহজ করতে প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তখন কৃষকরা আরও বেশি উৎফুল্ল হয়ে ফসল উৎপাদন করবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দিপক চন্দ্র হাজরা বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অসাধারণ পরিবর্তন আসায় মাদারীপুর জেলায় কৃষি ফসলের উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। পদ্মা সেতুর এক বছরে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগামী দিনে আরও বেশি ফসল উৎপাদন করা হবে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন,পদ্মা সেতু হওয়ার পর মাদারীপুর জেলায় অনেক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যক কল-কারখানাসহ অসংখ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে করে মাদারীপুরবাসীর নতুন কর্মসংস্হানের সুযোগ হয়েছে।
পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর জেলার কৃষি পণ্য ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আগামী দিনে জেলার কৃষকরা যেন আরও বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।