নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারত থেকে আমদানির পরও কমছে না আলুর দাম। রাজশাহীর ৩৬টি হিমাগারে এখনো আলু মজুত আছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ বস্তা। তবে দাম না কমলেও খালি হতে শুরু করেছে হিমাগারগুলো।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থল বন্দর দিয়ে গত এক সপ্তাহে আলু এসেছে ১ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন। আসার অপেক্ষায় আছে আরও ২৬ হাজার মেট্রিক টন। ভারত থেকে আমদানিকৃত আলু এখন পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। সপ্তাহে পার হয়ে গেলেও কমেনি দাম।
এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের হিমাগারগুলোতে এখনো আলুর মজুত আছে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। হিমাগারগুলোতে বিপুল পরিমাণ আলু মজুত থাকলেও ব্যবসায়ীরা তা বিক্রি করছিলেন না। অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম বাড়তে থাকে। তিন মাস আগেও প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। গত সপ্তাহে তা বেড়ে হয় ৬০ টাকা কেজি। বিভিন্ন কাঁচাদ্রব্যের দামের পর এবার আলুর দামে কারসাজিতে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।
কোল্ডস্টোরেজে সরকার নির্ধারিত দামে প্রতি কেজি ২৬ থেকে ২৭ টাকায় আলু বিক্রি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত বুধবার (১ নভেম্বর) থেকে একজন মনোনীত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হবে বলে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী নগরীর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, আলুর বড় ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বিক্রি না করায় বাজারে চাহিদামতো আলু পাওয়া যাচ্ছিল না। এক মাসের ব্যবধানে বাজারে প্রতি কেজি আলুতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে কার্ডিনাল, ডায়মন্ড ও অ্যাস্টেরিক জাতের আলু বেশি চাষ হয়। গত কয়েক বছর থেকেই বাড়ছে আলুর চাষ। ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় এবার ৩৬ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। যা গত বছর ছিল ৩৮ হাজার ৫৪৩ হেক্টর। এবার উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৫১ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। যা গত বছর ছিলো ১০ লাখ ২০ হাজার ২৩১ মেট্রিক-টন।
রাজশাহী থেকে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত আলু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়। এলাকার অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষক আলু উৎপাদনের পর তা বিক্রি করেন। আর ব্যবসায়ীরা তা কিনে হিমাগারে মজুত করেন। বর্তমানে কৃষকদের কাছে কোনো আলুর মজুত নেই। হিমাগার থেকে সীমিতভাবে আলু সরবরাহ করা হতো। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় আলুর দাম বেড়েই চলেছে।
কৃষি অধিদফতর জানিয়েছে, রাজশাহীতে কৃষক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি। পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি। আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি। আর খুচরা পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি।
রাজশাহী জেলায় আছে ৩৬টি হিমাগার। এসব হিমাগারে এখনো আলুর মজুত আছে ৪৮ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। ৬০ কেজির বস্তায় আলু মজুত করা হয়। সেই হিসেবে রাজশাহীর বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে প্রায় ৭ লাখ ৬৮ হাজার বস্তা মজুত আছে। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে এই আলু বিক্রি শুরু হয়েছে।
এবার হিমাগার ভাড়াসহ ৬০ কেজির প্রতি বস্তা অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড ও কার্ডিনাল আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে খরচ হয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আলু ব্যবসায়ী বলেন, ‘হিমাগারে আলু মজুত করে তিন বছর লোকসান হয়েছে। তখন আমাদের কেউ খোঁজও নিতে আসেননি। এবার আলুর দাম একটু বেশি হতেই সবাই চিৎকার শুরু করেছেন। অথচ বাজারে অন্যান্য সবজির দাম কত বেশি। সে নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই।’
পবা উপজেলার একটি কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘হিমাগারে কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করেন বেশি। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। গত তিন বছর আলুতে লোকসান হয়েছে। এবার বাজার ভালো হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করছেন। তাই এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা কেউ আলু বিক্রি করতে চাইছেন না। প্রতিদিন সামান্য পরিমাণ আলু হিমাগার থেকে বিক্রি হচ্ছে।’
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ মালিক সমিতির সভাপতি আবু বাক্কার বলেন, ‘এখন কোল্ড স্টোরেজ ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করছে। যা আলু আছে তা ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে আবার নতুন আলু আসবে। মার্চ থেকে হিমাগারে রাখা হবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি বিপণনের সহকারী পরিচালক আফরিন হোসেন বলেন, ‘রাজশাহী জেলার হিমাগারগুলোতে আলুর এখনো বিশাল মজুত আছে বলে জেনেছি। আমি নিয়মিত বাজার মনিটরিং করি। হিমাগারেও খোঁজ নিচ্ছি। আলুর দাম কমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা যদি সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘রাজশাহী জেলায় যে আলু উৎপাদন হয় তা চাহিদা মিটিয়েও থেকে যায়। এই আলু রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। আলুর কোনো ঘাটতি নেই। কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে রাখেন ব্যবসায়ীরা। তারা হিমাগারে মজুত করে।’
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছিল আমরা সেভাবেই পালন করছি। কোল্ড স্টোরেজ থেকে সরকারের নির্ধারিত মূল্য আলু বিক্রি হচ্ছে। যা মজুত আছে তা দিয়ে এই মৌসুম চলে যাবে।’