বৃহস্পতিবার | ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জয়পুরহাটে নবান্ন উৎসবে মেয়ে-জামাইদের নিয়ে মাছের মেলা

প্রিয় রাজশাহী ডেস্ক: অগ্রাহায়ণ মাস। শুরু হয়েছে জয়পুরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে প্রাণের নবান্ন উৎসব। কৃষকদের ঘরে উঠেছে নতুন ধান। পিঠা-পায়েসসহ নানা আয়োজনে মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের নিয়ে পালিত হচ্ছে কৃষকের কাঙ্খিত প্রাণের নবান্ন উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে জামাইদের নিয়ে জয়পুরহাটের কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে এক দিনের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা বসেছে জমজমাটভাবে। এদিনকে ঘিরে পাঁচশিরাতে ভোর ৪টা থেকে দিনব্যাপী চলে মাছ কেনাবেচার উৎসব। এই দিনের অপেক্ষার প্রহর গুণেন এ উপজেলার প্রত্যন্ত এলকার লোকজন। ক্যালেন্ডার নয়, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রাহয়ণ মাসের প্রথম শনিবার এ প্রতিবছর বসে এ মেলা।

সীমান্তঘেঁষা জেলায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ভোর থেকেই মেলাজুড়ে ছিল ক্রেতা-বিক্রেতা আর কৌতুহলী মানুষের ঢল। প্রায় একশ’ বছর থেকে চলে আসা এই মেলায় নদী, দীঘি ও পুকুরে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছে ছিল ভরপুর। সকাল থেকেই ক্রেতারা ভিড় জমাতে থাকে। মাঠ থেকে নতুন ফসল কৃষকদের ঘরে উঠলেই অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শনিবার আয়োজন করেন নবান্ন উৎসবের।

এই অনুষ্ঠান পালন করতে আসেন সারাদেশে বসবাসরত তাদের জামাই-মেয়ে, বেয়াই-বেয়ানসহ আত্মীয়-স্বজনরা। মূলত প্রতিযোগিতা করেই মেলা থেকে জামাইরা মাছ ক্রয় করে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। তাইতো মেলার প্রতিটি দোকানে সাজানো ছিল দেশীয় জাতের বোয়াল, রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, ব্রিগেট, বাঘাআইরসহ নানা ধরনের মাছ।

মেলায় সর্বোচ্চ ২৮ কেজি ওজনের কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ৩৩ হাজার ছয়শ’ টাকায়। এই মেলার আয়োজনও করতে হয়না। এই দিন আসলেই বসে জেলার বৃহৎ এ মাছের মেলা। তবে স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে মেলার প্রস্তুতি নেন। আশেপাশের এলাকায় তারা মাইকে প্রচারও করেন।

ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শনিবার এ মেলা বসে। এই দিনে নতুন ধান কাটার উৎসবে কৃষকদের প্রস্ততকৃত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত এই নবান্ন উৎসব। প্রতি বছরের অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার পর নবান্ন উৎসব আয়োজন করেন জেলার প্রান্তিক কৃষকরা।

সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত তাদের জামায় ও আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ করেন এই দিনে। এই অনুষ্ঠান পালন করতে যোগ দিতে আসেন জামাই-মেয়ে, বেয়াই-বেয়ান ও আত্মীয়-স্বজনরা। এই দিনে জেলার গ্রামীন জনপদে মেতে ওঠে উৎসবের আমেজ। কৃষকদের ঘরে ঘরে শুরু হয় নতুন চালের নবান্ন।
পিঠাপুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই ও মুড়ি খাওয়ার ধুমতো আছেই। কৃষকদের পরিবারে ঘটে মিলন উৎসব। তাইতো দিনটি উদযাপন উপলক্ষে জেলার বৃহৎ মাছের মেলা বসেছে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে। মাছ ব্যবসায়ীরা তাদের আড়তে এলাকার বিভিন্ন দীঘি, পুকুর, নদী থেকে নানা জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। মেলা উপলক্ষে এ দিনে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি, পেশাজীবী মানুষরা উচ্চমূল্যে এসব মাছগুলো ক্রয় করেন। এ বছর মেলায় বোয়াল, রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, ব্রিগেট, বাঘাআইরসহ ৩ কেজি থেকে ২৮ কেজি ওজনের মাছের সমাগম চোখে পড়েছে। আগের তুলনায় এ বছর মেলায় লোকজনের উপস্থিতিও ছিল বেশী। মাছ ক্রয়-বিক্রয়ও হয়েছে প্রচুর। কাউকেই খালি হাতে মেলা থেকে ফিরে যেতে চোখে পড়েনি। সাধ্যমতো সবাই মাছ ক্রয় করেছেন।

মেলায় মাছ বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ও উজ্জল চন্দ্র বর্মণ বলেন, মাছের মেলাতে পুকুর, দীঘি ও নদী থেকে নানা জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল ৭শ’ থেকে ১২শ’ টাকা কেজিতে এবং বাঘাআইর, বোয়াল ও চিতল মাছ ১৩শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। আর মাঝারি আকারের মাছ ৩৯০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা ছিল বেশী। মাছও বিক্রি হয়েছে। দামও ছিল স্বাভাবিক। এবার মাছ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়নি। লাভও হয়েছে মোটামুটি।

মেলায় মাছ কিনতে এসেছে পঞ্চগড় জেলা থেকে আগত উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের ঝামুটপুর গ্রামের জামাই মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এই মেলা উপলক্ষ্যে শ্বশুর প্রতিবছরই দাওয়াত করেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রতিবছরই মেলায় আসি। এবার ১৭ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনেছি। অন্য বছরের চাইতে এবার মাছের দাম একটু বেশী। তারপরও আনন্দ লাগছে।

পুনট পাঁচপাইকা গ্রামের রাশেদুজ্জামান মিঠু বলেন, এই দিনের অপেক্ষায় আত্মীয়-স্বজনরা তাকিয়ে থাকে। প্রতিবছর সকলকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে হয়। আবার বাড়ীতে যাওয়ার সময় তাদেরকে দিতেও হয়। এবার ছোট-বড় মিলে ৫০ হাজার টাকার মাছ কিনেছি।

কালাই পৌরশহরে পূর্বপাড়া মহল্লার আব্দুল মান্নান বলেন, এই দিনের অপেক্ষায় মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি ও আত্মীয়-স্বজনরা চেয়ে থাকে। তাই, ৯ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনেছি।

পাঁচশিরা বাজার ইজারাদার ছানোয়ার হোসেন ছানো বলেন, এ মেলার কোনো আয়োজক নেই। প্রতিবছর এই দিনে মাছের মেলা বসে। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা মেলার আগে এক সপ্তাহ ধরে এলাকায় মাইকে প্রচার করে। এই দিনে মেলায় প্রচুর মাছ আমদানি যেমন হয়, তেমনি বিক্রিও হয়।

মুক্তিযোদ্ধা বাবু মুনিশ চৌধুরী বলেন, এই দিনে হিন্দু-মুসলিমের কোনো ভেদাভেদ নেই, যা মেলায় আসলেই বোঝা যায়। হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে মেলায় মাছ কেনার মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করছেন। এই দিনের অপেক্ষায় মেয়ে-জামাই ও আত্মীয়-স্বজনরা তাকিয়ে থাকেন।

কালাই উপজেলা মৎস কর্মকর্তা আনোয়ার আলী বলেন, প্রতি বছর এই দিনে পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলা বসে। মেলায় ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠেছে। বড় বড় মাছ দেখে এ এলাকার চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। আজকের এই মেলায় কমপক্ষে এক কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হবে। মৎস বিভাগ চাষীদের সবসময় মাছ চাষে পরামর্শ দিয়ে আসছে।

কালাই পৌরসভার মেয়র রাবেয়া সুলতানা বলেন, নবান্ন উৎসবকে ঘিরে আজকে পাঁচশিরা বাজারে বসেছে মাছের মেলা। এতেই শেষ নয়, পৌরসভার প্রত্যেক বাড়ীতে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আরও বড় উৎসব চলছে। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এই দিন পালন করা হয়। আগামীতে মেলার পরিধি আরও বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.