নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজশাহীর তানোরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ৫০ বিঘা কৃষিজমিতে চলছে অবাধে পুকুর খনন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষি জমির ধ্বংসযজ্ঞ চললেও সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে নির্বিকার।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে রাতের আঁধারে পুকুর খননের কাজটি করছেন। আর চেয়ারম্যানকে সহযোগিতা করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহায়ক আলমাস কবির রকি।
এলাকার কৃষক ও ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, এর ফলে ওই এলাকার অন্তত চার গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পুকুরসংলগ্ন প্রায় আটশ বিঘা জমিও বছরের অর্ধেক সময় পানির নিচে থাকবে। ফলে ধান চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। ওই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় এক হাজার টন ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবেন কৃষক। এলাকার শতাধিক কৃষক জীবন এবং জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়বেন।
এছাড়া ইতোমধ্যে খননের কাজ চলা পুকুরের পাশে গত বছর আরও তিনটি পুকুর রয়েছে। প্রভাবশালী একজন পুকুর মালিক সরকারি খালের ২০ বিঘা জমি দখলে নিয়েছেন। ফলে সরকারি খাল বিলীন হয়ে এখন পুকুরের পেটে চলে গেছে। চারটি পুকুর মিলে দুইশ বিঘা কৃষিজমি ধ্বংস করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২ জানুয়ারি তানোরের কামারগাঁ ইউনিয়নের হাতিশাইল নিজামপুরে প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন পার্শ্ববর্তী বনকিশোর দেউল এলাকার ফখরুল ইসলাম ওরফে ফকির।
এরপর বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে অভিযান চালান তানোর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবিদা সিফাত। জরিমানা করা হয় ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া মাটি খনন করা যন্ত্র এক্সকেভেটরের চারটি ব্যাটারিও জব্দ করা হয়।
কিন্তু অদৃশ্য কারণে ৬ জানুয়ারি থেকে আবারও শুরু হয় পুকুর খনন। স্থানীয়রা বলছেন, কামারগাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলে রাব্বি মিয়া ফরহাদ স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেছেন। ফরহাদ তানোর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা যুবলীগের সভাপতি লুৎফল রশিদ হায়দার ময়নার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এ কারণে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি পুকুর খননের কাজটি অব্যাহত রেখেছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান ফরহাদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেটি সঠিক না। পুকুর খননের বিষয়টি আমি জানি। তবে এর সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট না। তাছাড়া ওই মাঠে ধানের ফলন সেভাবে হয় না। এ কারণে হয়তো পুকুর খনন করছে।
বৃহস্পতিবার রাতে সরেজমিন দেখা গেছে, রাত ১০টায় পুকুর খননের কাজ চলছে। তবে সে সময় মালিক ফখরুল ইসলাম ফকির সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। আকাশ হোসেন নামে একজন এক্সকেভেটর চালক খননের কাজটি করছিলেন। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করছিলেন মালিকের কর্মচারী হাতিশাইল এলাকার ইয়ামিন। রাতের অন্ধকারের কারণে মাঠের মধ্যে পুকুরের আয়তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়নি।
তবে শুক্রবার সকালে সরেজমিন সেখানে গেলে পুকুর খননের বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে স্পষ্ট হওয়া যায়। দেখা গেছে, ইতোমধ্যে পুকুর খননের শতকরা ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। ৫০ বিঘা আয়তনের বিশাল পুকুরের পাড় দেওয়ার কাজ চলছে। বাকি কাজ সম্পন্নের জন্য ঘটনাস্থলে দুটি এক্সকেভটর ও একটি ড্রেজার মেশিন রয়েছে।
কৃষিজমিতে পুকুর খননের ফলে ওই মাঠের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তারা জানিয়েছেন। পুকুরসংলগ্ন জমির মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার তিন বিঘা জমি রয়েছে। বোরো এবং রোপা ধান চাষ করা হয়। পুকুর খননের ফলে বর্ষা মৌসুমে এ মাঠের পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হবে। জলাবদ্ধতার কারণে জমি বছরের অর্ধেক সময় পানির নিচে থাকবে। ফসল ফলবে না। এ কারণে এ মাঠের প্রায় শতাধিক কৃষক সমস্যার মধ্যে পড়বেন।
ওই মাঠের কৃষক বারোঘরিয়ার হাফিজুর রহমানের দুই বিঘা, একই গ্রামের কাশেম কাজির চার বিঘা, ছাউড় গ্রামের নাইমুল ইসলামের তিন বিঘা, হাতিনান্দার ফয়েজ উদ্দিনের চার বিঘা ও হাতিশাইলের মকবুল হোসেনের সাড়ে তিন বিঘা জমি রয়েছে। তারা বলেন, এ মাঠের জমি ধানচাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বছরে দুবার ধান চাষ হয়। প্রতিবিঘা জমিতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৭ মন করে ধান উৎপাদন হয়।
বিলে জমি রয়েছে প্রায় ৮০০ বিঘা। বছরে প্রায় ২৭ থেকে ২৮ হাজার মন ধান উৎপাদিত হয়। ফলে এ পরিমাণ ধান থেকে তারা বঞ্চিত হবেন।
এ মাঠের কৃষক শামীম সোনা এবং সবুর উল্লাহ বলেন, পার্শ্ববর্তী মোহনপুর উপজেলার কেশরহাটের আব্দুল করিম ও শাফিউল ইসলাম শাফি এ মাঠে আরও তিনটি পুকুর খনন করেছেন। করিম মাঠের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ২০ বিঘার একটি সরকারি খাস খালও দখল করেছেন। এ খালটি এখন পুকুরের পেটে চলে গেছে। এ খাল দিয়ে পাশের হরিপুর, চন্দনকোটা, ছাউড় ও হাতিনান্দা গ্রামের পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু এখন আর সেটি হবে না। শুধু মাঠ নয়, এর ফলে গ্রামগুলোতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে।
অভিযোগ উঠেছে, তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহায়ক আলমাস কবির রকি তানোর এলাকায় মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুকুর খননের কাজে সহযোগিতা করছেন। এর আগে এ অভিযোগে রকিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বিভাগীয় মামলা। তবে ৬ মাস আগে তার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর থেকে তিনি আবারও মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে পুকুর খননের কাজে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করছেন।
তবে অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্যের জন্য অফিস সহায়ক আলমাস কবির রকিকে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রহিম বলেন, পুকুর খননের বিষয়টি শুনেছি। এ ব্যাপারে প্রশাসন থেকে নির্দেশনা পেলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিল্লাল হোসেন বলেন, এলাকাটি দুর্গম। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) পাঠিয়েছিলাম। তিনি খনন কাজ বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু রাতের আঁধারে আবারও হয়তো শুরু করেছে।
তিনি বলেন, অফিস সহায়ক রকির ব্যাপারে পুকুর খননে সহযোগিতার অভিযোগে তাকে শোকজ (দর্শানোর নোটিশ) করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সরকারি খালের ২০ বিঘা জমি পুকুরের মধ্যে রয়েছে, সেটিও শুনেছি। তানোরে আমি যোগদানের আগে সেটি হয়েছে। খাল উদ্ধার ও পুকুর খনন বন্ধ করার জন্য আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নেব।