প্রিয় রাজশাহী ডেস্কঃ আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করেছে প্রায় ৫ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। যদিও এই পরিমাণ ছিল ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের মোট ব্যয়ের মাত্র ছয় শতাংশ।
এরপর গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, চিকিত্সক ও রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, অন্যতম মূল এই খাতে সরকারের প্রকৃত ব্যয় প্রায় স্থবির এবং কিছু অর্থবছরে এটি বরং কমেছে।
উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে ২০২১-২২ অর্থবছর। এই বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা বা মোট ব্যয় ৫ লাখ ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকার মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
এর আগের অর্থবছরে সরকার মোট ব্যয় করেছে ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যেখানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ শতাংশ বা ২১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের এই হতাশাজনক ব্যয় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। এর ফলেই দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষকেও স্বাস্থ্য খাতে উচ্চ ব্যয় বহন করতে হচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের শাখা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের সর্বশেষ প্রকাশনা অনুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মানুষকে তাদের চিকিত্সা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদেরকে বহন করতে হয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের উপরে আছে শুধুমাত্র আফগানিস্তান-দেশটির নাগরিকদের ৭৮ শতাংশ ব্যয় নিজেদের বহন করতে হয়।
এই খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ২০১২ সালে বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসার ৬২ শতাংশ ব্যয় বহন করতে হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কোনো জায়গাতেই স্বাস্থ্যখাত আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। সরকারও এদিকে যথাযথ মনোযোগ দেয় না। এ কারণে এই খাতে মানুষের ব্যয় বাড়ে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার কারণেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলো এত বেশি রোগীকে সেবা দিতে পারে না। যার কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালেও তারা প্রত্যাশিত সেবা পায় না।’
অধ্যাপক হামিদ বলেন, ‘এর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে, বাংলাদেশ একটি অস্বাস্থ্যকর জাতিতে পরিণত হচ্ছে এবং চিকিৎসা সেবার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।’
একই কথা বলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ডা. এনামুল হক। তিনি জানান, তারা দেখেছেন যে মানুষ ওষুধ কিনতে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করছে এবং ধনীরা দরিদ্রদের তুলনায় আরও বেশি টাকা এই বাবদ ব্যয় করেন। সে কারণেই বাংলাদেশে এই খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ অনুসারে, বাংলাদেশের মতো দেশে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অন্তত পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। কিন্তু, বাংলাদেশে এই খাতে সাধারণত বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় এক শতাংশ।
প্রতি বছর এই খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়তে থাকে। কিন্তু সেটা হয় জাতীয় বাজেটের আকার বৃদ্ধির কারণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের সিংহভাগই ব্যয় হয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য।
তাদের মতে, আরও দুঃখজনক বিষয় হলো-ভুল অগ্রাধিকার নির্ধারণ, অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অভীষ্ট নাগরিকদের কাছে পৌঁছায় না।
ডা. এনামুল জানান, বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করতে পারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বরাদ্দকৃত অর্থ দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আরও বেশি বাজেট পাব এবং স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের ব্যয় কমবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার জন্য অতিরিক্ত খরচ পরিবারের ওপর বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং তাদের সবকিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়ছে। তারা আরও দেখতে পান যে, দরিদ্র পরিবারগুলো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা এড়ানো বা দেরিতে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার কারণে তাদের ব্যয় বাড়ছে অসহনীয় পর্যায়ে।
স্বল্প আয়ের মানুষেরা কম খরচের জন্য এমন সব জায়গা থেকে চিকিৎসা সেবা নেয় যা তাদের পরবর্তীতে স্বাস্থ্য খাতে খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজেটে বরাদ্দ কম তারওপর অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার অভাবটিও সামনে এসেছে।
এমনকি বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো থেকেও মানুষ যে সেবা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ওষুধ ও মেডিকেল টেস্টে খরচে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রকল্প গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও এর বিপরীতে কোনো পারফরম্যান্স কালচার গড়ে উঠতে দেখি না আমরা।’
এই অর্থনীতিবিদ আশা করেন, যে তহবিলগুলো এখনো ব্যয় হয়নি সেগুলো দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে ভালো স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ সোভেন নিয়েলসনের মতে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এলে আর্থিক কষ্ট সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। সূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার