মঙ্গলবার | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুঠিয়া রাজবাড়িঃ ইতিহাস যেখানে হাতের মুঠোয়

প্রিয় রাজশাহী ডেস্কঃ রাজশাহীর বিশেষত্ব বলতে বা জানতে সবার প্রথমে আমের নাম চলে আসে। এতে অবশ্য দোষের কিছু নেই! তবে এর বাইরেও অনেক কিছু আছে, যা এই জেলাকে অনন্য করেছে। যেমন রাজশাহী শহরের সৌন্দর্য! এই শহর এতটাই সাজানো-গোছানো, তাই আমি রাজশাহী শহরকে বাংলাদেশের সব শহরের মধ্যে প্রথম কাতারে রাখব। শহরের মধ্যেই  রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! এর গৌরবান্বিত অধ্যায় আপনাকে মোহিত করবে, ঠিক তেমন বিখ্যাত প্যারিস রোড আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য করবে। প্রাণকেন্দ্রেই রয়েছে বরেন্দ্র জাদুঘর! বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস আপনি এখানে পেয়ে যাবেন হাতের মুঠোয়। আর অবশ্যই বাদ যাবে না পদ্মার পাড়। বিকেল থেকে রাত অবধি এখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন অবলীলায়।

পুরো শহরকে নিয়ে অনেক কিছু বলার থাকলেও আজ আমার বিষয় বস্তু হলো, শহরের বাইরে, পুঠিয়ার রাজবাড়ি। রাজশাহীর পুঠিয়া থানায় অবস্থিত এই রাজবাড়ি মূলত একটি জমিদারবাড়ি। মোগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে সেই সময়ের জমিদার ‘রাজা’ উপাধি পাওয়ার পর জমিদারবাড়ি থেকে রাজবাড়ি নামেই পরিচিত হয়। যদিও বর্তমান রাজবাড়িটি সেই আমলের নয়; বরং আরও অনেক বছর পর ১৮৯৫ সালে নির্মিত হয়েছিল এই রাজবাড়ি! মজার ব্যাপার হলো, রাজবাড়ির নির্মাতা কোনো রাজা নন, তিনি হলেন একজন রানি।  তাঁর নাম হেমন্ত কুমারী দেবী। মানিকগঞ্জের কন্যা হেমন্ত কুমারী দেবী যতীন্দ্র নারায়ণকে বিয়ে করে পুঠিয়ার রাজবাড়ির বউ হিসেবে আসেন। দুঃখজনকভাবে অল্প সময়ে বিধবা হন। শাশুড়ির মাধ্যমে রাজবাড়ির দায়িত্ব পান তিনি। শাশুড়ির সম্মানার্থেই তিনি এ বিখ্যাত স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য মহারানি খেতাব পান। রাজশাহী, নওগাঁসহ অনেক জেলায় তাঁর অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের নমুনা এখনো দেখা যায়।

টিকিট করে প্রবেশ করতে হয় এ রাজবাড়িতে। আয়তাকার এ দালান দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চারপাশ অনেক খোলামেলা। নিচ থেকে দোতলা অবধি রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশালাকার স্তম্ভ। আর দোতলার সম্মুখে পুরো অংশে রয়েছে বিশাল এক বারান্দা। বারান্দার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে রেলিংয়ের কারুকার্য। শুধু তা-ই নয়, দরজা, রুম এবং ছাদের দিকে বিভিন্ন কারুকার্য আপনাকে এখানে অনেক সময় উপভোগ করতে উৎসাহ দেবে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আলো-ছায়ার একটা খেলা চলে এখানে।

ভেতরের রুমগুলো অনেক বড়, যেমনটা হতো সেই সময়ে। ভেতরেই কয়েকটা কক্ষ দিয়ে বানানো হয়েছে জাদুঘর। এ জাদুঘরে আপনি পাবেন রাজশাহীসহ আশপাশের জেলার কষ্টিপাথরসহ অন্য সামগ্রী দিয়ে নির্মিত দেব-দেবীর মূর্তির পুরোনো নিদর্শন। রয়েছে মধ্যযুগের ধাতব এবং মাটির তৈরি অনেক ব্যবহার্য সামগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবিসহ তথ্য।

রাজবাড়ির সামনে রয়েছে বড় একটি খোলা জায়গা আর এক পাশে দিঘি, সেখানে রানির স্নানের জন্য বানানো বেশ বড় একটা ঘাট এখনো আছে। রাজবাড়ির পেছনেই রয়েছে বড় গোবিন্দমন্দির। শুধু তা-ই নয়, বেশ কিছু মন্দির আছে আশপাশে। যেমন বড় শিবমন্দির, দোলমন্দির, গোপালমন্দির, কেষ্টখ্যাপার মঠ, রথমন্দির ও গোবিন্দমন্দির।

বড় শিবমন্দির আসলেই অনেক বড়। মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে একটি দিঘি। বেশ কিছুটা সিঁড়ি পার হয়ে যেতে হয় মন্দিরে। দেয়ালে দেয়ালে কিছু কারুকার্য দেখেছি, তার অনেক কিছুই এখন নষ্ট হয়ে গেছে।

অনতি দূরেই রয়েছে দোলমন্দির! এ মন্দিরের বিশেষত্ব হলো এর দরজা। অসংখ্য দরজা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এ মন্দির। স্থানীয় লোক তাই একে হাজার দুয়ারের মন্দির ও বলে থাকেন। চারতলাবিশিষ্ট এই মন্দিরে নিচতলা থেকে ওপরের তলায় পর্যায়ক্রমে কক্ষের সংখ্যা কমতে থাকে। যদিও এর ভেতরে কোনো প্রতিমা নেই, তাই অনেকেই ধারণা করেন, মন্দিরের উদ্দেশ্যে এ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি।

রাজবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে পাশাপাশি আছে তিনটি মন্দির। এগুলোর নাম হলো গোপালমন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির এবং ছোট গোবিন্দমন্দির। একই প্রাচীরের মধ্যে তিনটি মন্দির স্থাপিত হয়েছে। স্থাপত্যশৈলিতে অনন্য প্রতিটি মন্দির। টেরাকোটা আর মন্দিরের আকার-আকৃতিতে আপনি মুগ্ধ হবেন।

পুঠিয়া রাজবাড়ি আর এর আশপাশে মন্দির দেখার পর আমার দেখার সৌভাগ্য হলো, ‘হাওয়াখানা’ দেখার। রাজবাড়ী থেকে হাওয়াখানার দূরত্ব আনুমানিক তিন কিলোমিটার। রাজবাড়ির সদস্যরা নিজেদের অবকাশযাপনের উদ্দেশ্যে এই ভবন নির্মাণ করেছিলেন, যার চারপাশজুড়ে আছে দিঘি। শোনা যায়, ঘোড়ায় চড়ে রাজবাড়ি থেকে এখানে যাওয়া-আসা করতেন, নৌকায় চড়তেন, মাছ ধরতেন। বিকেলের হিমেল বাতাস উপভোগ করতে চাইলে সুযোগ এখনো আছে আপনার।

ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত এ রাজবাড়ি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সেই জমিদারি বা রাজবাড়ির কোনো কার্যক্রম এখন নেই। তবে রয়ে গেছে শক্তিশালী স্মৃতি। প্রাচীন এসব স্থাপনা দেখতে আমরা যাঁরা পছন্দ করি, তাঁদের জন্য এ রাজবাড়ি হতে পারে দারুণ কিছু। এক দিনের মধ্যে সহজে ঘুরে আসতে পারবেন।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী যেকোনো বাসে উঠে যেতে পারেন। রাজশাহী শহরের আগেই পুঠিয়া থানার বাজার নেমে যেতে হবে। আর ট্রেন বা বিমানে এলে রাজশাহী শহরে পৌঁছে সেখান থেকে লোকাল বাস বা অন্যান্য যানবাহন করে পুঠিয়া ত্রি-মোহনী বাজারে আসতে হবে। এই ক্ষেত্রে সময় লাগবে আনুমানিক ৪০ মিনিট। সেখান থেকে অটোরিকশা, রিকশাভ্যানে করে রাজবাড়ি পৌঁছাতে পারবেন ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই। সূত্রঃ প্রথম আলো

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.