গত ০৯ জুলাই (মঙ্গলবার) নিজের ফেসবুক ওয়ালে এ খোলা চিঠি লিখেন অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ।
অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদের লিখা খোলা চিঠিটি পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো-
জনাব
সালাম জানবেন। আমি আপনার নগরে ২৮ বছরের বেশি সময় থেকে বসবাস করছি। সেই বিবেচনায় চোখের সামনেই এই নগরকে বদলে দেয়া, সৌন্দর্যের মডেল নগর তৈরি হলো আপনার হাতের ছোঁয়া ও কনস্টাক্টিভ ও পরিকল্পনা দিয়েই। আমার মতো এক নগন্য মানুষের চেয়ে এই রাজশাহী মহানগরের মাটি, মানুষ, সবুজ ঘাস, পদ্মা নদী সব কিছুর প্রতি আপনার ভালোবাসা অতুলনীয় এবং হাজার কোটি গুণ বেশি, আমি সেখানে একদম কেউ না। আমি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এক এক আগন্তুক আপনার নগরে। ছোটবেলায় বাসে যেতে হাইওয়ে থেকে খানিক দূর আরেকটা মাটির কাচা রাস্তায় প্রবেশমুখে সাইনবোর্ডে লেখা ‘জাহানারা কামারুজ্জামান কলেজ’ দেখে ভাবতাম কাদের নামে এই কলেজ! অনেক পরে জেনেছি আপনার মা বাবার নামে এক্কেবারে মফস্বলে একটা কলেজ। এখন আর ঐ দিকে আমার যাওয়া হয় না। আপনার মহানগরেই রুটিরুজির জন্য লেপ্টে থাকতে হয়। এই আটাশ বছরে একটা পিছিয়ে থাকা নগর চোখের সামনে সৌন্দর্যের এক লীলাভূমিতে পরিণত করার কারিগর আপনি, যাদুকরও আপনি দেখছি। আমার জানা নাই এতো দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে অন্য কোনো নগরের উন্নয়ন হয়েছে কী না, যেটা রাজশাহীতে হয়েছে, হচ্ছে।
আপনি আজকের এই খোলা চিঠি লিখছি অন্য বিষয়ে। মহানগরে বাস টার্মিনাল ও বাসস্ট্যান্ড। যখন রাজশাহী আসি, শিরোইল বাস টার্মিনাল চিনতাম এবং শুনতাম নওগাঁ রোর্ডের পাশে নগর থেকে বেশ দূরে নতুন বাস টার্মিনাল হবে। এই শোনা আটাশ বছর আগে থেকেই। তখন ভাবতাম আর মনে মনে কষ্ট পেতাম এই ভেবে শহর থেকে অতদূরে আবার বাস টার্মিনাল হয় না কি! এখন কষ্টটা ঠিক উল্টো। মহোদয় আপনার কাছে নিশ্চয় উপাত্ত আছে আপনার নগরের বুকের ভেতর থেকে কতটা জায়গা থেকে বিভিন্ন রুটে বাস ছেড়ে যায়।
এগুলো টার্মিনাল নয় কিন্তু ভয়ঙ্কর অসুন্দর, শহরে জ্যাম, গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি করছে, উন্নয়নের চিত্রে স্পট বা দাগাচ্ছে। যদি বলি রুয়েটের সামনে বিআরটিসি, তালাইমারী রাস্তার উপর খানিকটা দম নেয়া স্টপেজ, পথচারীদের তুলতে টানাটানি ভদ্রা মোড়। এটা বাসস্ট্যান্ড না টার্মিনাল বোঝা মুসকিলই শুধু নয়; জটিল সমীকরণ। ভদ্রা থেকে শিরোইল বাস টার্মিনাল টু বিন্দুর মোড় পুরো রাস্তার দুই পাশে সারি সারি থামিয়ে রাখা বাসগুলো, ট্রেন নামা কিংবা ঢাকা বাস স্ট্যান্ড এখানে যেনো যাত্রীর ভীড়ে আর হেলপারদের চিল্লাচিল্লিতে মোচ্ছব লেগে থাকে।
আপনি হয়তো জানেন না শুভ পেট্রোল পাম্প থেকে বিন্দুর মোড় যেতে কি পরিমাণ জ্যাম লেগেই থাকে। ট্রাফিক পুলিশ যেনো অসহায় এখানে। অন্য রাস্তার মতো যাওয়া আসার পথ কোনটা তা বোঝা মুসকিল। এখানে অনিয়মকারীদের সাথে কথা বললেই বাড়িতে ফিরে পেইন কিলার ও নাপা খেতে হবে। এরা বেপরোয়া।
এই বিন্দুর মোড়ে চাপাই যাওয়ার লোকাল ও গেটলক খ্যাত বাসগুলোর দম নেয়ার স্ট্যান্ড। অন্যদিক শহীদ কামারুজ্জামান চত্বর থেকে রেললাইন পাড় হয়ে রেল ভবনের সামনে নওগাঁ, জয়পুরহাট, আক্কেলপুর, মঙ্গলবাড়ী, বাস, সিএনজি, স্কুটারের স্ট্যান্ড অন্যদিকে আলুপট্টিতে আরেকটা বাসস্ট্যান্ড। বিআরটিসি। শহরের ভেতরে কোন বাহনগুলো চলবে আর কোনগুলো চলবে না তার কোনো নীতিমালা আছে কী না আমার জানা নাই। সিএনজি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা প্রতিদিন হুড়হুড় করে বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর চালকদের নুন্যতম ড্রাইভিং এর প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে হয় নি এখনো। কিনছে আর রাস্তায় নেমে যাচ্ছে।
আপনার স্বপ্নের শহর দুঃস্বপ্নে শহরে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন জ্যামিতিক গতিতে। আমি এটাও জানি বাস মালিক সমিতি কিংবা বাস শ্রমিক সমিতির ক্ষমতা ও দাপট আকাশ ছোঁয়া। আটাশ বছরে দেখলাম না টার্মিনাল থেকে বাস ছেড়ে শহরে না ঢুকে বিভিন্ন রুটে চলে যাওয়া। সব বাস কোনো না কোনোভাবে নগরের ভেতর দিয়েই বিভিন্ন রুটে যাচ্ছে। এতে নগরের ভেতরে আপনার গড়া রাস্তাগুলো (এভিনিউ) দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। আমরা কি সেটাই চাই!!
মাননীয় মেয়র মহোদয় আপনি বেশ কয়েকটি বাইপাস রোড করেছেন। নগরবাসী আপনাকে নিয়ে গর্ব করে। বিদেশি পর্যটকদের মন কেড়েছেন আপনি। আপনি সিটি করপোরেশন ও আশেপাশে যত রাস্তার করেছেম, সেগুলোর আধুনিকায়ন করেছেন, সজ্জিত করেছেন অতীতের যেকোনো সময়ে অন্য কোনো মেয়রের সামর্থে ছিলো বা। ভবিষ্যতেও হয়তো অন্য কারো সামর্থ হবে না। এর কারণ হিসেবে বলতে পারি রাজশাহীর মাটির প্রতি আপনার ভালোবাসা ও কমিটমেন্ট।
আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন সিটি করপোরেশন বা সিটি করপোরেশনের বাইরে থেকে অনেকে ব্যাটারি ইজি অটোরিকশা কিনছে, তারা কেউ লাইসেন্স পায়, কেউ পায় না। তারচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো এই অটোরিকশা চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে হয় না। শহরে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি হচ্ছে যেগুলো কষ্ট দায়ক। ইদানীং সিএনজি চালিত যানও শহরে ঢুকছে দাপটের সাথে।
সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তাহলো আপনার পরিশ্রম, আপনার ভালোবাসার নগর, সিটি করপোরেশনের সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্ন নগরী দ্রুত অপরিচ্ছন্ন ও আয়ু হীন হয়ে পড়ছে।
প্রিয় নগরপিতা, তাই মনে করি দ্রততার সাথে নগরের উন্নয়নের স্বার্থে, সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থে, পরিচ্ছন্ন নগরীর প্রয়োজনে রাজশাহী সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯ এর ৪১ (১৯) ধারার আওতায় বাসস্ট্যান্ডগুলো বাস টার্মিনাল থেকেই বিভিন্ন রুটে চলাচলের ব্যবস্থা নাগরিক জীবন স্বস্তি ও শান্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। ধন্যবাদ আপনাকে। পত্রের ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
ড. মুসতাক আহমেদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
লেখকঃ অধ্যাপক ড. মুসতাক আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।