নিজস্ব প্রতিবেদক: বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এই প্রথম বোরো চাষের জন্য পানি সংকটাপন্ন এলাকায় সেচঘণ্টা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবার বোরো মৌসুমে ৯৮০ ঘণ্টার বেশি কোনো গভীর নলকূপ থেকে সেচ দেওয়া যাবে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএমডিএ।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর আট উপজেলায় বোরোখেতে পানি দেওয়ার জন্য এবার ৯৮০ ঘণ্টার বেশি কোনো গভীর নলকূপ চালানো যাবে না। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এই নিয়মে সেচ দিতে হবে। আর সারা বছরে ১ হাজার ৯৬০ ঘণ্টার বেশি গভীর নলকূপ চালানো যাবে না।
এত দিন নলকূপচালকেরা প্রয়োজনমতো কৃষকের জমিতে সেচ দিয়েছেন। বিএমডিএর এই সিদ্ধান্তে বোরো চাষে সেচসংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। তাঁদের হিসাবে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভীর নলকূপের পানিতে এক–তৃতীয়াংশ বোরোখেতেও সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না।
গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গভীর নলকূপ চালানোর বিষয়ে নতুন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সম্পর্কে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেন রাস্টন দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করেছেন। তাঁর গবেষণা থেকে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার আটটি উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এসব এলাকার পানি উত্তোলন কমিয়ে দিলেই শুধু এই এলাকা দ্রুত মরুকরণের হাত থেকে রেহাই পাবে এবং খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) জরিপেও এই এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। তারা এলাকার মাটির নিচ থেকে খাওয়ার পানি ছাড়া অন্য কাজের পানি ব্যবহার না করার সুপারিশ করেছে। এসব গবেষণা ও জরিপের আলোকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিএমডিএ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বিএমডিএর ১ হাজার ৯৮০টি গভীর নলকূপের পানি দিয়ে বোরো ধান চাষ করা হয়। পাশাপাশি এই নলকূপগুলো থেকে ৪ লাখ ২১ হাজার ৮১৫ জন উপকারভোগী খাওয়ার পানি নিয়ে থাকেন। এ জন্য তাঁরা প্রতি মাসে পরিবারের ব্যবহার অনুযায়ী নির্ধারিত হারে পানির দাম পরিশোধ করে থাকেন। ৪৬৬টি গভীর নলকূপে ওভারহেড ট্যাংক রয়েছে। এগুলো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে উপকারভোগীদের বাড়ির ট্যাপে পানি সরবরাহ করা হয়। আর বাকি নলকূপ থেকে কলসিতে করে উপকারভোগীরা পানি নিয়ে থাকেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার রাজশাহী জেলায় ৭০ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৬৫ হেক্টর বেশি। তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলায় বেশি বোরো ধান চাষ হয়ে থাকে। গভীর নলকূপ চালানোর বিধিনিষেধের কারণে এসব অঞ্চলের কৃষকেরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বিগত বোরো মৌসুমে একটি গভীর নলকূপ দিনে ২০–২২ ঘণ্টা চলেছে। আর এখন দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি চালানো যাবে না। এর মধ্যে খাওয়ার পানি সরবরাহ করতে চলে যাবে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। বাকি আট বা সাড়ে আট ঘণ্টার মধ্যে বোরো ধান ছাড়া অন্যান্য রবি ফসল-ভুট্টা, গম, শর্ষে, আমবাগান, পেয়ারাবাগান , মাল্টাবাগানে পাানি দিতে হবে। এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। মার্চের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ সময়ে বৃষ্টি না হলে ১০ ঘণ্টায় তিন বিঘা জমিতে সেচ দেওয়াই কঠিন হয়ে যায়।
গোদাগাড়ীর গোলাই এলাকার কৃষক আনিসুজ্জামান বলেন, পানি দেওয়ার নতুন নিয়ম করার কারণে তাঁদের স্কিমের জমি দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে এবার বেরো ধান হবে; অন্য ভাগে পরেরবার। তাঁর দুই একর জমি এবার বোরোর আওতায় পড়েছে। পরেরবার অন্য ফসল করতে হবে। আর এবার বোরোর বাইরে পড়েছে তিন বিঘা। তাতে অন্য ফসল করতে হবে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে প্রতিটা গভীর নলকূপ পরিচালনার জন্য কমিটি থাকত। সেই কমিটি নির্ধারণ করত ওই নলকূপের অধীনে কত বিঘা জমিতে বোরো ধান বা অন্যান্য ফসল চাষ করা হবে। এখন সেই কমিটি নেই। আবার নলকূপের যে অপারেটর রয়েছেন, সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরা নিয়োগ পাবেন কি না, তা–ও অনিশ্চিত। অন্তত ছয় মাস আগে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএমডিএর সিদ্ধান্ত নিতে হতো।
বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইতিমধ্যে কৃষকদের মধ্যে প্রচারপত্র স্টিকার বিলি করা হয়েছে। উপজেলা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। নাচোল ও আমনুরায় উপকারভোগীদের নিয়ে দুটি সভা হয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁরা পদ্মা নদী থেকে পাইপের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আবার আগের মতো বোরোখেতে সেচ দেওয়া যাবে।