প্রিয় রাজশাহী ডেস্ক: সয়াবিন ও পামওয়েলের দাম বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। এ জন্য ট্যরিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। দাম বাড়ানোর পিছনে তারা যুক্তি দিচ্ছেন বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার। এ নিয়ে রোববার (৮ ডিসেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক হলেও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকোচ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আরো যাচাই-বাছাইয়ের।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো সোমবার আবারও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে ট্যারিফ কমিশন। বৈঠকে বিশ্ব বাজারে কতোটা বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম এবং তার সঙ্গে সমাঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে কতো বাড়ানো যাবে, নাকি দাম বাড়ানোর দরকার হবে না-এসব বিষয়গুলো ক্ষতিয়ে দেখা হবে। গতকাল রোববারের বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ট্যারিফ কমিশনের বাণিজ্য নীতি বিভাগের উপ-প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর দাবি তুলে ছিলেন। তারা বলেছেন বিশ্ব বাজারে দাম বেড়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেন দেশের বাজারেও দাম বাড়ানো হয়। তবে ব্যবসায়ীরা লিটারে কতো টাকা বাড়ানো দরকার সে প্রস্তাব দেননি। আমরা তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ব বাজারের কি অবস্থা এবং দেশের বাজারে দাম বাড়ানোর দরকার আছে কিনা-সব বিষয় আমরা যাচাই করে দেখবো। এ জন্য আজ ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবারও বসবো আমরা। তারপর আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবো। সুতরাং এখনই দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে না।
বাজারে এখনো নৈরাজ্য
এদিকে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল নিয়ে এখনো নৈরাজ্য চলছে। ভোজ্যতেল বাজার থেকে উধাও বললেই চলে। পাঁচ-ছয়টি দোকান ঘুরে মিলছে একটিতে, তাও দাম গুনতে হচ্ছে বেশি। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলেও একই অবস্থা। বোতলজাত তেল না থাকায় গত কয়েকদিনে খোলা তেলের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার তেল কেনায় জুড়ে দিচ্ছেন শর্ত।
হঠাৎ কেন এমন সংকট- জানতে চাইলে মুখ খুলছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা কথা বলছেন না কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছে না। তবে বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এখন তেল বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। যে কারণে তেলের দাম বাড়াতে প্রস্তাব করেছে সরবরাহকারীরা। তবে সরকার দাম বাড়াতে চায় না। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারকে চাপে ফেলতে কোম্পানিগুলো কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করেন খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা।
দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্তমান সরকার দুই দফায় আমদানি শুল্ককর কমালেও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বাজারে। প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ক-কর কমালেও আমদানি বাড়েনি, বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।
কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা তেলের অর্ডার নিচ্ছেন না। প্রায় দুই সপ্তাহ বাজার থেকে কিছু কিছু বোতল কিনে নিয়মিত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছি। এখন সেটাও নেই।– খুচরা দোকানি
ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ তেল নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক থেকে দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। ক্রেতারা যে দু-একটি বোতল পাচ্ছেন, তারও দাম রাখা হচ্ছে বেশি। আবার কোনো কোনো বিক্রেতা আটা ও লবণ না কিনলে তেল দিচ্ছেন না। বোতলজাত তেল না থাকায় খোলা সয়াবিন ১৮৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে, যা দুদিন আগে ১০ টাকা ও দুই সপ্তাহ আগে প্রায় ২০ টাকা কম ছিল। আবার কোনো দোকানে প্রতি লিটার তেল সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৭ টাকা, ২ লিটার ৩৩৪, ৫ লিটার ৮১৮ দাম লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। যতটুকু আসছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এখন যা বিক্রি হচ্ছে সেটা খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মজুত তেল।
অন্যদিকে অধিকাংশ বিক্রেতার দাবি, রমজান সামনে রেখে কোম্পানিগুলো এখন থেকেই বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। এ নৈরাজ্য কোম্পানিগুলোর নতুন নয়। পতিত সরকারের সময় এ পন্থায় কেম্পানিগুলো প্রতি বছর রোজার আগে দাম বাড়িয়েছে। এখনো তাই হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, শুল্ককর কমানোর ফলে ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ার কথা, উল্টো আমদানি কমেছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি বলে সরবরাহকারী কোম্পানি যে দাবি করছে তাও যুক্তিযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে তেল সরবরাহকারী একাধিক কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকদিন ধরেই তারা গণমাধ্যমে মন্তব্য করছেন না।
অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় শত শত কার্টন সয়াবিন তেল মজুত করে এখনকার কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। আবার তারাই বিক্রয় প্রতিনিধিদের দিয়ে গুজব ছড়িয়েছে যে, বাজারে তেল নেই। এরপর সয়াবিন তেল সরবরাহ দিচ্ছে না।
ভোজ্যতেল নিয়ে কঠোর অভিযান চালানোর নির্দেশ
এদিকে সয়াবিন তেলের এই সংকটকে ঘিরে কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। গতকাল রবিবার সকালে বাজার অভিযানে যাওয়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিমগুলোকে এই নির্দেশনা দেন।
জানা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৬ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ছয়টি টিম বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। মহাপরিচালক এসব টিমকে ভোজ্যতেল তথা সয়াবিন/পাম অয়েল ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। চাহিদা অনুযায়ী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সরবরাহ পাচ্ছেন না। ১০০ লিটার সয়াবিন তেলের চাহিদার বিপরীতে মিল থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ২০ লিটার। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলেছেন, মিল মালিকরা নাকি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাজারে তেলের সংকট বেড়েই চলছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন রমজানে ভোজ্যতেলের সংকট সমগ্র বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে।