সোমবার | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত স্বামী, ৫৪ বছর থেকে মুরগির মাংস খাননি স্ত্রী

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালে ১৩ ডিসেম্বর সোমবার। জোহরুন বেগমের চুলায় রান্না হচ্ছিল মুরগির মাংস। স্বামী জসিমউদ্দিন তাদের গরুকে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন। পাঁচজন পাকিস্তানপন্থী লোক এসে আমাদের বাড়িতে ঢুকে দক্ষিণ ভিটার ঘর থেকে আমার স্বামী জসিমউদ্দিন ও তার ভাই ফজলুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এরপর আর ফিরে আসেননি। তারপরের দিন বিদ্যালয়ের মাঠে পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। জসিমউদ্দিনের মরদেহও পাওয়া যায়নি। তাকে এবং তার ভাইকে সেখানেই গণকবর দেওয়া হয়।

স্বামী মারা যাওয়ার ৫৪ বছরেও আর মুরগির মাংস মুখে তুলেননি স্ত্রী জোহরুন বেগম। তার বয়স এখন ৮৪ ছাড়িয়েছে। তবুও সেদিনকার সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি তিনি। শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের খড়িয়ার গ্রামে তাদের বাড়িতে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কান্না জড়িত কণ্ঠে করলেন সেদিনকার স্মৃতিচারণ।

তিনি বলেন, আমার স্বামী ও ভাসুরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে তারা আমাদের ধমক দিয়েছিল। বলেছিল যে ‘কান্না না থামলে তোদের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলবো’। এরপর ভয়ে আর তাদের সামনে যেতে পারিনি।

আমার স্বামী জসিমউদ্দীন ও আমার ভাসুর ফজলুর রহমানকেও ধরে নিয়ে যাবার পর আর ফিরে আসেনি। তখন থেকে আমি আর কোনদিন মুরগির মাংস খেতে পারিনি। যখন কেউ মুরগির মাংস খাবার জন্য অনুরোধ করে তখনই আমার স্বামীর কথা মনে হয়। কারণ ওই মুরগীর মাংস আমার স্বামীর জন্যই রান্না করছিলাম। আমার জীবনের পণ যতদিন বাঁচবো, ততদিন মুরগির মাংস খাবো না। আমি একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছেই আমি বিচার প্রার্থী ।

তিনি আরও বলেন, তাদের ধরে নিয়ে যাবার পর আমার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া আবদুস সোবহান মধুকে নিয়ে পাকিস্তানপন্থী এলাকার কয়েকজনকে হাত-পা ধরে অনুরোধ করেও কোন লাভ হয়নি। পরের দিন মঙ্গলবার সকালে লোকজনের মুখে শুনলাম আমার স্বামীসহ কয়েকজনকে হুমায়ুন রেজা উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণে মাঠে গুলি করে মেরে ফেলেছে। লোকমুখে শুনেছি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে এ অবস্থাটা বুঝতে পেরে সারাদেশে বুদ্ধিজীবী এবং স্বাধীনতাপন্থীদের হত্যার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে ।

আমার স্বামী শহীদ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি ও ১০০০ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে। ।

শহীদ জসিমউদ্দিনের ছোট ছেলে শহিদুল ইসলাম সাধু কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, আমি বাবার স্বাদ পাইনি। বুঝিনি বাবার আদর কি। কারণ তখন আমার বয়স মাত্র দেড় বছর। আমি আমার মায়ের মুখ থেকে বাবার কথা শুনেছি। আমি চাওয়া পাওয়ার হিসাব কোনদিনই করিনি । আমার বাবা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, এটাই বড় কথা। এটাই আমাদের গর্ব। কোন হিসাব মিলাতে যাই না তবে আমার বাবা আমাদের মাতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এতে আমরা গর্বিত।

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.