নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর পবা উপজেলা পরিষদ চত্বরে ঢুকলেই পুকুরপাড়। সেই পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ‘এক টুকরো’ পাঠাগার। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে যাওয়ার আগেই চোখে পড়বে পাঠাগারটি। একটি বেদিতে দেয়াল তুলে করা হয়েছে বই রাখার স্থান। কাঁচের পাল্লা টেনে যে কেউ সে বই নিয়ে পড়তে পারবেন। এ জন্য করা হয়েছে বসার জায়গা। বই পড়া শেষে আবার রেখে দিতে হবে। নিবন্ধিত পাঠকেরা এই বই বাড়িও নিতে পারবেন পড়ার জন্য।
উদ্বোধনের পরই পাঠক টানছে এই পাঠাগার। বিজয় দিবসে গত ১৬ ডিসেম্বর পাঠাগারটির উদ্বোধন করেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার। পাঠাগারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলোর উঠান’। পবার ইউএনও মো. সোহরাব হোসেন পাঠাগারটি গড়ে তুলেছেন নিজ উদ্যোগে। তাঁর এমন উদ্যোগের প্রশংসা করছেন পাঠকেরা।
সোমবার দুপুরে পাঠাগারের পাশে গোলঘরে বসে বই পড়ছিল পবার নওহাটা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাসনিমের হাতে হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতালহাওয়া’। সপ্তম শ্রেণির সাফিয়া তাসনিমের হাতে হুমায়ূন আহমেদের ‘নির্বাচিত ভূতের গল্প’। নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী রুফাইদা ফেরদৌসের হাতে দেখা গেল সৈয়দ শামসুল হকের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’। অষ্টম শ্রেণির পুষ্পিতা পূর্ণার মনোযোগও বইয়ের পাতায়।
রুফাইদা ফেরদৌস বলল, দুদিন আগে তারা খবর পেয়েছে যে স্কুলের কাছেই এমন একটি পাঠাগার করা হয়েছে। তাই ক্লাস শেষে তারা কয়েকজন এসেছে পাঠাগারটি দেখতে। আসার পরে তারা নিজেরাই পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়ছে। এই পাঠাগার তার কাছে অনেক আকর্ষণীয় লাগছে।
বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে পুষ্পিতা পূর্ণা বলল, ‘মাঝে মাঝেই তো আমাদের বিভিন্ন ইভেন্ট থাকে এখানে। তখন আসতে হয়। এখন থেকে যতবার আসব, ততবার এই পাঠাগারে বসব।’
উপজেলার নিকটবর্তী শিশু সাহিত্যিক হাসনাত আমজাদ এর বাড়ি। খবর পেয়ে তিনিও এসেছেন ভিন্নধর্মী এ-ই পাঠাগার দেখতে। সাথে নিয়ে এসেছেন নিজের লেখা দুটো ছড়ার বই- ‘মাঠের ছবি ঘাটের ছবি’ আর ‘যাই হারিয়ে ছেলেবেলায়’। বই দুটি পাঠকদের পড়ার উদ্দেশ্যে পাঠাগারে উপহার দেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হাতে তুলে দিলেন তিনি।
এ বিষয়ে তাঁর অনূভুতি জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল বই। প্রচুর বই পড়তাম আমরা। বিনোদন ও জ্ঞান অর্জন দুই দিকেই লাভবান হতাম। এখন সময় বদলেছে। বই পড়ার দিকে আগ্রহ অনেক কম এখনকার ছেলেমেয়েদের। সেদিক থেকে চিন্তা করলে এ-ই সময়ে আলোর উঠান চমৎকার এক উদ্যোগ। এ-ই জাতীয় উদ্যোগ বিভিন্ন পর্যায় থেকেও নেয়া উচিত।’
পবায় এ দিন উপজেলা প্রশাসনের কার্যক্রম দেখতে এসেছিলেন মৌলিক প্রশিক্ষণে থাকা বিসিএস ক্যাডারের ১০ জন নবীন কর্মকর্তা। ইউএনও সোহরাব হোসেন উপজেলা প্রশাসনের নানা কার্যক্রম দেখানোর পর তাদের এই পাঠাগারটি দেখাতে আনেন। এমন উদ্যোগের প্রশংসা করতে দেখা গেল নবীন কর্মকর্তাদেরও। বললেন, এমন উদ্যোগ তারা এর আগে দেখেননি।
কথা হয় ইউএনও সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, এখন সবাই ভার্চুয়াল মাধ্যমেই ডুবে থাকছেন। অফিস থেকে বাসায় যাতায়াতের সময় লক্ষ্য করেন, উপজেলা পরিষদে সেবা নিতে আসা মানুষকে কোন কারণে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলে এখানে-ওখানে বসে তারা মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাই তাদের বইমুখী করতে ছোট্ট এই পাঠাগারটি গড়ে তুলেছেন তিনি।
ইউএনও জানান, তাঁর কার্যালয় থেকে একটি ফরম নিয়ে পূরণ করে নিবন্ধিত পাঠক হতে পারবেন যে কেউ। তারা পাঠাগার থেকে বই বাড়িও নিয়ে যেতে পারবেন। যারা নিবন্ধিত পাঠক নন, তাদের পাঠাগারের পাশেই গোল ঘরে বই পড়ে আবার এখানে রেখে দিতে হবে।
এই পাঠাগারের পাঠকদের পুরস্কৃত করার পরিকল্পনার কথাও জানান ইউএনও। তিনি বলেন, নিবন্ধিত পাঠক যেসব বই পড়বেন তার পর্যালোচনা লিখে তিনি জমা দেবেন। পাঠাগারের পরিচালনার জন্য একটি কমিটি থাকবে। সেই কমিটি প্রতি ছয়মাস পর পর সেরা পাঠক নির্বাচিত করবেন তাদের লেখা বইয়ের পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করে। এতে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।
পাঠাগারটি সিসি ক্যামেরার আওতায় হলেও সার্বক্ষণিক কেউ এর দায়িত্বে থাকবেন না। বই চুরি যাওয়ার ভয় আছে কি না, এমন প্রশ্নে ইউএনও বলেন, ‘পাঠক যদি পড়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে যান, তাহলে সেটা অপরাধ না। কিন্তু পেশাদার কোন চোর বই চুরি করতে এলে সেটা অপরাধ। সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’