নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বালুমহাল ইজারা নিয়ে অবাধে মাটি কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নদীর তীরবর্তী এলাকার পলি মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রির ফলে পদ্মাপারের গ্রামগুলো ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এর প্রতিবাদ করার কারণে মারধরের শিকার হয়েছেন স্থানীয় এক ছাত্রদল নেতা। এখন গ্রামবাসী ও বালুমহালের ইজারাদারের লোকজন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গোদাগাড়ী উপজেলার ফুলতলা ও প্রেমতলী-শেখেরপাড়া বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন মোখলেসুর রহমান মুকুল নামের এক ব্যক্তি। তার বাড়ি রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফুলতলা ও শেখেরপাড়া বালুমহালের পাশাপাশি বিদিরপুর স্বপন ঘাটিয়ালের বাড়ির পাশে আরেকটি অবৈধ ঘাট খুলেছেন তিনি। এই তিন বালুমহালেই নদী থেকে বালু তোলার পাশাপাশি মাটি কাটা হচ্ছে তীরের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বালুমহালের ইজারাদার মোখলেসুর রহমান মুকুল তালিকাভুক্ত হুন্ডি ব্যবসায়ী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি রাজশাহী-৩ আসনের নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান আসাদের পেছনে অর্থ খরচ করেন। আসাদ এমপি নির্বাচিত হলে তিনি তাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দেন। এরপর আসাদের দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজের মেসার্স মুন এন্টারপ্রাইজের নামে গোদাগাড়ীর দুটি বালুমহাল বাগিয়ে নেন মুকুল।
তিনি বালুমহাল ইজারা নেওয়ার পর থেকেই মাটি কাটা হচ্ছিল। কিন্তু তৎকালীন এমপি আসাদের লোকজনের ভয়ে গ্রামের মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর স্থানীয়রা বালুমহালে মাটি কাটার প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। সম্প্রতি কয়েকদফা তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। উপজেলা সদরে সম্প্রতি মানববন্ধনেরও আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন। তারা বালুমহাল বন্ধের দাবি জানান।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর মোখলেসুর রহমান মুকুল আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু এরই মধ্যে এই বালুমহালের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতা। মুকুলের হয়ে সবকিছু দেখাশোনা করছেন তার ভাই মো. বাবু ও ভাতিজা সাজিম। সাজিম রাজশাহী মহানগর যুবদলের সদস্য বলে এখন পরিচয় দিচ্ছেন।
মাটিকাটা ইউনিয়নের এই তিন বালুমহালে মাটি কাটার প্রতিবাদ করার কারণে গত মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) মারধরের শিকার হয়েছেন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ও উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুদ্দিন টমাস। তার বাড়ি বালুমহাল সংলগ্ন মাদ্রাসা মোড় এলাকায়। আহত সাইফুদ্দিন টমাস এখন উপজেলা (প্রেমতলী) স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। তাকে মারধরের প্রতিবাদে এলাকাবাসী বুধবার বিকালে শেখেরপাড়া বালুমহালের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। তারা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আহত সাইফুদ্দিন টমাস জানান, এলাকার মানুষ বালুমহালে মাটি কাটার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। এখানে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও অংশ নিচ্ছেন। এ জন্য রাজশাহী জেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল সরকার ডিকো তাকে ফোন করে হুমকি দেন। এসব প্রতিবাদ করা যাবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। আমি তাকে স্থানীয়দের অসুবিধার কথা জানালে তিনি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।
টমাস জানান, মঙ্গলবার দুপুরে তিনি রাজশাহীর আদালতে আসেন আওয়ামী লীগের আমলের একটি মামলার হাজিরা দিতে। এই খবর পেয়ে যান বালুমহালের ইজারাদার মুকুলের ভাতিজা সাজিম। তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে চান। এরপর কৌশলে একটু আড়ালে নিয়ে যান। এরমধ্যেই আরও ছয়-সাতজন যুবক চলে আসেন। তারা তাকে বেধড়ক মারধর করেন। এরপর তিনি পালিয়ে আইনজীবীদের বসার স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি বের হলে এবার জেলা যুবদলের নেতা ফয়সাল সরকার ডিকোর নেতৃত্বে তার ওপর হামলা হয়। মারধরের পর ডিকো তাকে শাসিয়ে যান যে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখান থেকে আবার তুলে নিয়ে গিয়ে পেটানো হবে। প্রাণের ভয়ে তিনি রাজশাহীতে হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে গোদাগাড়ী যান এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবদল নেতা ফয়সাল সরকার ডিকো বলেন, ‘টমাস দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা দাবি করেছিল। এ জন্য আমি তাকে ফোন করি। কারণ, ইজারাদারের ভাতিজা সাজিম রাজশাহী মহানগর যুবদলের সদস্য। টমাস আমাকে বলে, “এসব বলার আপনি কে?’’ কিন্তু আমি তাকে মারধর করিনি। বরং আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচিয়েছি।’
ইজারাদার মুকুলের ভাতিজা সাজিম বলেন, ‘টমাসকে আমরা মারিনি। বালুমহাল থেকে চাঁদা দাবির কারণে জনগণ তাকে গণপিটুনি দিয়েছে।’ বালুমহাল গ্রামে শহরের কোন জনগণ গণপিটুনি দিলেন জানতে চাইলে সাজিম বলেন, ‘আপনি তো পক্ষপাতিত্বমূলক প্রশ্ন করছেন।’
টমাসকে মারধরের প্রতিবাদে বুধবার বিকালে শেখেরপাড়া বালুমহালের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এতে পুরো গ্রামের মানুষ অংশ নেন। সেখানে বক্তারা বলেন, ‘যখনই ঘাটে মাটি কাটার প্রতিবাদ করা হয়, তখনই গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়। গত বছর তো ইজারাদার গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। আমরা বালুমহাল থেকে কোন চাঁদা চাই না। এই ইউনিয়নে কোন বালুমহালও চাই না।’
গোদাগাড়ীর ইউএনও আবুল হায়াত বলেন, ‘গ্রামবাসীর অভিযোগ যে, বালুমহালে মাটি কাটা হয়। আর ইজারাদারের অভিযোগ, কেউ কেউ চাঁদা না পেয়ে বালুমহাল বন্ধ করে দিতে চায়। এটা নিয়ে বেশ জটিলতা। ইজারার মেয়াদ আর চারমাস আছে। এটা শেষ হলে এবার আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে বসব। তারা না চাইলে আর বালুমহাল ইজারা দেওয়া হবে না।’