মঙ্গলবার | ৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মধুমতির ১০৫ কোটি নিয়ে শঙ্কায় ৩৫ হাজার গ্রাহক

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁপাইনবাবগঞ্জে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি অনিবন্ধিত এনজিও মালিক মাসুদ রানা আটকের পর জামানতের ১০৫ কোটি টাকা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ৩৫ হাজার গ্রাহক। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আদালতে ৩৭২টি মামলা হয়। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সুরাহা হয়নি।

শনিবার (৪ জানুয়ারি) আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে দুপক্ষের আইনজীবী ও মাসুদ রানার প্রতিনিধিরা ৫০টি মামলার বাদী ও গ্রাহকের সাক্ষাৎকার ও তথ্য সংগ্রহ করে। এ নিয়ে প্রত্যেক শনিবার মামলার বাদীদের সাক্ষাৎকার ও তথ্য গ্রহণ করে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়। তবে মামলার বাদী ও অন্যান্য গ্রাহকদের অভিযোগ, ৩৭২টি মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতেই এমন নাটক করা হচ্ছে এবং ষড়যন্ত্রের একটি নতুন কৌশল এটি।

জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ৪৬টি শাখায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে আটক হয় মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা। এরপর একে একে টাকা ফেরতের দাবিতে মামলা করেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। পরে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিক মাসুদ রানা এবং প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মাসুদ রানার পরিবারের ১৮ জন সদস্য কারাগারে থাকলেও টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকরা।

অভিযোগ উঠেছে, সরকারের পতনের পর মাসুদ রানা ও তার পরিবার আত্মসাতের ১০৫ কোটি টাকা ফেরত না দিতে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে টালবাহানা শুরু করে। এমনকি যেকোনো মূল্যে ৩৭২টি মামলায় জামিন নিয়ে বাইরে আসার পরিকল্পনাও করছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, টাকা ফেরত না দিতে নানারকম ষড়যন্ত্রের খবরে আরও ১০০০ মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।

শনিবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার পর মামলার বাদী টুম্পা ভট্টাচার্য জানান, আমি অনেক কষ্টে টাকা জমা দিয়েছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। কিন্তু মালিক মাসুদ রানা আটকের পর তা নিয়ে নাচোল আমলি আদালতে মামলা দায়ের করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। এখন সাক্ষাৎকারে এসে তার আইনজীবী বলছে, কিছু টাকা নিয়ে জামিন দিলে হয় না? কিন্তু এতো হয়রানির পর কেন কম টাকা নেব? এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে গ্রাহকের টাকা নিয়ে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের গ্রাহক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘জামানতের টাকা হারিয়ে আমরা ৩৫ হাজার গ্রাহক এখন পথে বসেছি। অথচ আমাদের শতকোটি টাকা নিয়ে জেলে বসে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন মাসুদ রানা ও তার পরিবারের সদস্যরা। মাসুদ রানা ও তার পরিবারের ১৮ জন সদস্য গ্রাহকের এসব টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করার অপরাধে কারাগারে আছেন। আমরা গত ২ বছর ধরে ৩৫ হাজার গ্রাহক ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। আদালতের কাছে আবেদন, যেভাবেই হোক আমাদের এই টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করবেন।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক জানান, ৩৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৭২টি। অথচ আইনজীবীরা এখন শুধুমাত্র মামলার বাদীদের সঙ্গে বসছেন এবং তাদের টাকা ফেরতের কথা বলে সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ও প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তাহলে বাকি গ্রাহকরা আমরা কি করব? প্রয়োজনে আমরা ৩৫ হাজার গ্রাহকরা মামলা করব। এসব ষড়যন্ত্র করে টাকা ফেরত দিতে নানারকম টালবাহানা করছেন মাসুদ রানার লোকজন।’

মধুমতি গ্রাহক ফোরামের সভাপতি শ্রী রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘আমরা ৩৫ হাজার গ্রাহক মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মালিক মাসুদ রানার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি এবং সেসময় মাসুদ রানা ৫০ কোটি টাকা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন নতুন করে আবার ষড়যন্ত্র ও টালবাহানা শুরু করেছেন। আমরা গত ২ বছর ধরে মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন আন্দোলন করেছি। প্রয়োজনে আবারো কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি বাকি গ্রাহকরা মামলা করবো।’

মধুমতি গ্রাহক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মাওলা জানান, মাসুদ গং টাকা ফেরত না দিতে নানারকম টালবাহানা করছেন। আমরা গ্রাহকদের শতকোটি টাকা ফেরত নিয়ে শঙ্কায় দিনযাপন করছি। স্থানীয় প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার কাছে আবেদন, টাকা ফেরত ছাড়া যাতে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া হয়। কারণ মাসুদ রানার লোকজন আমাদের পাশ বইসহ সব ডকুমেন্ট নিয়ে নিলে পরবর্তীতে আমাদের ফেরত না দেয়াসহ নানারকম বিপদে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় আছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কালিনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাইমুল হক বলেন, ‘মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা জেলাজুড়ে ৪৬টি শাখায় অবৈধ ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সাধারণ জনগণকে এক লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে ১২০০ টাকা লাভ দেয়া হবে এবং জমা করা টাকা চাওয়া মাত্র ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে মধুমতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে জেলার পাঁচ উপজেলায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। আজকাল করে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে সময় পার করে এবং টাকা না দিতে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা স্বেচ্ছায় অস্ত্রসহ আটকের নাটক করেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের স্নাতক পড়ুয়া লতিফা খাতুন বলেন, ‘আমার কোনো ভাই নাই। বাবার উপার্জনের ৬ লাখ টাকা মধুমতি এনজিওতে জমা রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পরেও এখন চিকিৎসা করার জন্য টাকা উত্তোলন করতে পারছি না। বারবার এনজিও অফিসে ঘুরেও দেব দিচ্ছি বলে না দেয়ার পায়তারা করছে। টাকার জন্য এখন অসহায় দিনযাপন করছি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের বিজয় নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সানজিদা খাতুন জানান, জমি বিক্রি করে টাকা জমা রেখেছিলাম মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায়। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা তুলে বেতন দিতাম। কিন্তু কয়েক মাস থেকে টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছে এর মালিক পক্ষের লোকজন। এখন কলেজের বেতন দিতে পারছি না। জনগণের টাকা নিয়ে যে সমস্ত সম্পদ তৈরি করেছে, তা বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.