প্রিয় রাজশাহী ডেস্কঃ কিডনি বিক্রি করে প্রতারণার শিকার হয়ে নিজেই শুরু করেন কিডনি বিক্রির ভয়ংকর প্রতারণা। জনপ্রতি কিডনি ৫০ লাখ টাকা চুক্তি করলেও ভুক্তভোগীকে দেওয়া হতো মাত্র পাঁচলাখ টাকা। বাকি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিত।
বুধবার (১৯ জুলাই) রাতে রাজধানীর ভাটারায় অভিযান চালিয়ে চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাব বলছে, এখন পর্যন্ত চক্রটি প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে কিডনি নিয়েছে। এভাবে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা।
গ্রেফতার চক্রের মূলহোতা মো. আনিছুর রহমান। বাকি সদস্যরা হলেন-মো. আরিফুল ইসলাম রাজিব, সালাউদ্দিন তুহিন, সাইফুল ইসলাম ও এনামুল হোসেন।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১-এর অধিনায়ন লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য ভুয়া কাগজপত্রে ভারতে গিয়ে প্রতারিত হন আনিছুর রহমান। অর্থের বিনিময়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। তবে সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে আনিছুর দেশে ফিরে নিজেই কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ব্যবসায় নামেন। সেখানে ভারতে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করেন। অনলাইনে বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহ করে বৈধ ও অবৈধভাবে বিমানে বা স্থলপথে ভারতে পাঠাতেন।
র্যাব-১ জানায়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, বনানী ও মহাখালী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে অঙ্গিকারনামা এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা চুক্তির এফিডেভিট কপি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বহারা হচ্ছে অসহায় নিম্নমায়ের মানুষ।
আইনবহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের কার্যক্রমে চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। সম্প্রতি র্যাব সাইবার মনিটরিং সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনিসহ অন্যান্য মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জন্য বিক্রয় সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন অনলাইন এবং অফলাইন প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও ডোনারদের আকৃষ্ট করে থাকে।
লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ আরও বলেন, বিদেশে অবস্থানরত একেকজন কিডনি ক্রেতা জীবন বাঁচাতে ৪৫-৫০ লাখ টাকা খরচ করে কিডনি ক্রয় করেন। এ টাকার মাত্র ৪-৫ লাখ টাকা পায় গভীর প্রতারিত ডোনার। ৫-১০ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয় দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় দালাল, অসাধু ট্রাভেল এজেন্ট এবং অন্যান্য প্রতারকদের মধ্যে। বাকি প্রায় ৩০ লাখ টাকা ভোগ করে বিদেশে অবস্থানরত কিডনি পাচার সিন্ডিকেট।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র সীমার নিচের অসহায় মানুষগুলোকে টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে এ চক্র। কখনো তারা বলে সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে একটির বেশি কিডনি দরকার নেই, কখনও মিথ্যা আশ্বাস দেয় যে চিকিৎসার খরচ তারা বহন করবে। টাকার লোভে কিডনি হারিয়ে প্রায়ই অকর্ম হয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে অসহায় মানুষগুলো।
যেভাবে ফাঁদে ফেলে কিডনি নিত ভয়ংকর এ চক্র
র্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, চক্রটি চার ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। দেশে থাকা মূলহোতা আনিছ ঢাকায় বসে বিদেশে ডোনার পাঠানোর বিষয় তদারকি করে। চক্রের তৃতীয় দলটির সদস্য আরিফ এবং তুহিন প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।
পরবর্তীতে ঢাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে চতুর্থ গ্রুপটির হোতা সাহেবানা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক সাইফুল ইসলাম প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারাকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
এ চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী প্রথম চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারাকে কিডনি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মূলহোতা আনিছুর রহমান এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দর দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রবেশ করে এবং হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভুক্তভোগীদের বৈধ অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
চক্রের অন্যতম সদস্য সাইফুল ইসলাম সাহেবানা ট্যুরস আ্যন্ড ট্রাভেলস-এর মালিক। তিনি কিডনি ডোনারদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট ব্যাংক অ্যান্ডোর্সমেন্ট, মেডিকেল ডকুমেন্টস, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে থাকে। যেসব ডকুমেন্টের ঘাটতি থাকে, তাদের কাগজপত্র জাল জালিয়াতের মাধ্যমে প্রস্তুত করে থাকে। ২০২১ সালের র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছিল।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, অন্য কোনো চক্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আমরা পায়নি। তবে দেশের অভ্যন্তরে তারা দীর্ঘদিন ধরে কিডনি বেচাকেনা নিয়ে কাজ করছিল। চক্রটি এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কিডনি নিয়েছে। মূলত এসব চক্রে মোবাইলফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার কাজ করে আসছে। আমরা বেশকিছু পেজ নজরদারি করছি; ধারণা করছি এসব কাজে আরও বেশকিছু চক্র জড়িত রয়েছে। তাদের ধরার পরই আইনের হাতে সোপর্দ্য করবো।
কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কি না প্রশ্নের জবাবে র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, না আমরা এমন কাউকে পায়নি। তাদের কাছে যেসব কাগজপত্র পেয়েছে সেগুলো জাল। এগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমেই তৈরি করেছে যা দিয়ে ভিসা পাবার ব্যবস্থা করত। এরসঙ্গে কোনো হাসপাতালের সম্পৃক্ততা পায়নি।
একেক জনের সঙ্গে একেক ধরণের চুক্তি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করত। সেই টাকা কীভাবে ভাগ হতো? এমন প্রশ্নে র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ টাকা চুক্তি হতো। সেই টাকার মধ্যে যিনি কিডনি দিতেন তিনি চার থেকে পাঁচলাখ টাকা পেতেন। বাকি টাকা চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে বন্টন হতো। বিধান অনুযায়ী যারা যারা কিডনি দিতে পারবেন, চক্রটি তাদের বাইরে গিয়ে তা জোগাড় করে দিত-যোগ করেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।
সম্প্রতি সরকারি একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনে প্রতারণার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। এ প্রতারণার সঙ্গে এ চক্রটি জড়িত কি না প্রশ্নে র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, না, তাদের জড়িত থাকার এমন কোনো তথ্য এখনো পায়নি। সূত্রঃ জাগো নিউজ।
প্রি/রা/শা