নিজস্ব প্রতিবেদক: ফাঁকা চেক ফেরতের দাবিতে সুদ কারবারির বাড়ি ঘেরাও করেন ঋণগ্রহীতা ভুক্তভোগীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বোসপাড়া পুলিশ সদস্যরা আসেন ঘটনাস্থলে। আজ সোমবার সকালে রাজশাহী নগরের কেদুর মোড় এলাকায়
ফাঁকা চেক ফেরতের দাবিতে সুদ কারবারির বাড়ি ঘেরাও করেন ঋণগ্রহীতা ভুক্তভোগীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বোসপাড়া পুলিশ সদস্যরা আসেন ঘটনাস্থলে। আজ সোমবার সকালে রাজশাহী নগরের কেদুর মোড় এলাকায়ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী নগরে স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ নিয়ে সুদের টাকা পরিশোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নিয়ে জিম্মি করে সুদ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে সুদের একজন কারবারির বাড়ি ঘেরাও করেছেন ভুক্তভোগীরা। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঋণগ্রহীতারা অভিযোগ করেছেন, তাৎক্ষণিক টাকার প্রয়োজনে তাঁরা মোহনা মাহি নামের একজন কারবারির কাছ থেকে ঋণ নেন। সাপ্তাহিক সুদ প্রতি হাজারে ২০০ টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। ঋণ দেওয়ার সময় তাঁদের কাছ থেকে ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পরের সপ্তাহ থেকে সুদ পরিশোধ শুরু করেন তাঁরা।
কিন্তু আসল টাকা পরিশোধ করতে চাইলে মোহনা মাহি নেন না। সুদের টাকা জমা দেওয়ার কোনো কাগজপত্রও দেন না। এভাবে নানা কৌশলে তিনি গত কয়েক মাসে ২০-৫০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত সুদ নিয়েছেন। কিন্তু আসল আর শেষ হয় না। চেকের মামলার ভয় দেখিয়ে এই টাকা নিতেই থাকেন তিনি।
গত শনিবার নগরের কেদুর মোড় এলাকায় সুদের কারবারির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগী ঋণগ্রহীতারা। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন রুবিনা বেগম, কোহিনুর বেগম, বেলি বেগম, কমেলা বেগম, সেলিনা বেগমসহ অন্তত ১০ জন নারী। আজ সোমবার সুদ কারবারির বাড়ি ঘেরাওয়ের সময় তাঁরা ছিলেন।
রুবিনা বেগম দাবি করেন, তিনি বিপদে পড়ে ৬ মাস আগে মোহনা মাহির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সে সময় মোহনা তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর করা ফাঁকা চারটি ব্যাংক চেক নেন। পরের সপ্তাহ থেকে তাঁকে সুদ দেওয়া শুরু করেন। এভাবে ছয় মাসে তাঁকে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা সুদ হিসেবে দিয়েছেন। এখন বলছেন আরও টাকা দিতে হবে। ফাঁকা চেকও ফেরত দিচ্ছেন না। মামলার ভয় দেখাচ্ছেন। এ জন্য তিনি গত শনিবার নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন।
কেদুর মোড় এলাকার কোহিনুর বেগম বলেন, তিনি ৫ মাস আগে ৩০ হাজার ঋণ নেন। এখন পর্যন্ত ২ লাখের বেশি সুদ দিয়েছেন। টাকা না দেওয়াতে তাঁর বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকার চেকের মামলা করেছেন মোহনা মাহি। এখন পর্যন্ত তিনবার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। সুদের কারবারি আরও টাকা চান, কিন্তু ফাঁকা চেক ফেরত দিচ্ছেন না।
একইভাবে ওই এলাকার বাসিন্দা কমেলা বেগম ও সেলিনা বেগম সুদের টাকা পরিশোধ করতে করতে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার কথা জানান।
গত শনিবার মানববন্ধনের পর সুদের কারবারি মোহনা মাহি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁরা ফাঁকা চেক দিয়ে টাকা নিয়েছেন। এখন টাকা চাইতে গেলে গালাগালি করছেন। বাড়িতে লোকজন নিয়ে আসছেন। কেউ টাকা দিচ্ছেন না, অথচ তাঁরা চেক জমা দিয়ে টাকা নিয়েছেন।
কত শতাংশ হারে সুদ নেওয়া হচ্ছে, ফাঁকা চেক কেন নেওয়া হচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই সেদিন তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে গতকাল রোববার দুই দফা গিয়ে তাঁকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। আজ সোমবার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
একপর্যায়ে তিনি বলেন, তিনি তাঁদের বিপদে টাকা দিয়েছেন। কোনো সুদ নেননি। উল্টো তাঁরা টাকা নিয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। তিনি এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন।
সুদের কারবার ঘরে ঘরে
নগরের কেদুর মোড়, হাদির মোড়, পঞ্চবটী এলাকাজুড়ে ঘরে ঘরে সুদের কারবার চলে। সেখানে দিনভিত্তিক সুদের কারবারও হয়। কারও কাছ থেকে এক দিনের জন্য ১০ হাজার টাকা নিলে পরের দিনই ১ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। আর হাজারে সাপ্তাহিক ২০০ টাকার সুদ ওই এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে গেছে।
কেদুর মোড়ের বাসিন্দা মেহেরজান নামের এক নারী বলেন, তাঁদের এই এলাকার মানুষ নানা জায়গা থেকে কিস্তির টাকা তোলেন। কেউ মেয়ে বিয়ে দেন, কেউ ঘর করার জন্য টাকা নেন। কারও সন্তান মাদক খেয়ে, জুয়া খেলে টাকা খুইয়ে ফেললে ঋণ নিতে হয়। এককথায় ঋণ নেওয়ার মানুষের অভাব নেই।
আফজাল হোসেন নামের একজন বলেন, এই এলাকায় নারীরাই সুদের কারবার করেন। নারীরাই নানা কৌশলে সুদের টাকা তোলেন। আবার নারীরাই ঋণ নেন। কারও পাঁচ-দশ হাজার টাকা থাকলেই সুদের ব্যবসা শুরু করেন।
আজ সকালে সুদের কারবারি মোহনা মাহির বাড়ি ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে ওই এলাকায় যান বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সায়েদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকার ঘরে ঘরে সুদের ব্যবসা চলে।
নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাওয়ার্দী হোসেন বলেন, তাঁরা ওই এলাকা থেকে অভিযোগ পেয়েছেন। যদি ফাঁকা চেক জমা রেখে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন, তাহলে তাঁরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।
প্রি/রা/আ