বৃহস্পতিবার | ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২৭৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলো সরকারি খামারের ৩৭টি গরু

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাটে আঞ্চলিক দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারে নিলাম প্রক্রিয়া প্রতি বছরই সিন্ডিকেটের হাতে ধরাশায়ী হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার এই যোগসাজসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। এবারও সর্বোচ্চ ২৭৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলো সরকারি খামারের ৩৭টি গরু।

এদিকে কর্মকর্তারা সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করলেও দাবি করছেন, এখানে তাদের কেউ জড়িত নন।

গত সোমবার (১০ জুন) গোদাগাড়ীর ওই খামারেই এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। খামার কর্তৃপক্ষ চারটি ষাঁড়, ২১টি এঁড়ে, ১০টি গাভী ও ১৬টি বকনা মিলে মোট ৫১টি গরু নিলামের জন্য তোলে। নিলামে গরু কেনার জন্য ব্যাংক ড্রাফট (বিডি) জমা দিয়েছিলেন ৩৫৭ জন। তাদের মধ্যে নিলাম হেঁকেছেন মাত্র পাঁচ জন। তারা হলেন—কালু, তাজমুল, মেহেরাব, উৎসব ও লতিফ। অন্যরা হাততালি দিয়েছেন।

মোট ৫১টি গরুর মধ্যে এভাবেই পাঁচ জনের সিন্ডিকেট নিয়ে নেয় ৩৭টি গরু। অবশ্য নিলামের মাধ্যমে খামার ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের দুই কর্মকর্তাও দুটি এঁড়ে কিনেছেন। ছোট বলে বাকি ১২টি বকনা কেউ কেনেননি।

নিলামে ‘এ গ্রেডের’ ১২ মণ ওজনের একটি ষাঁড়ের দাম হাঁকা হয় ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। পরস্পর যোগসাজশে কালু, তাজমুল, মেহেরাব এই তিন জন মিলে ২০০ টাকা করে ডাকে দাম বাড়ান মোট ৬০০ টাকা। ষাঁড়টি বিক্রি হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকায়। অর্থাৎ ২৭৩ টাকা কেজি দরে এই গরু বিক্রি হয়েছে! বর্তমান কোরবানির হাটে এই ষাঁড়ের দাম অন্তত পোনে ৪ লাখ টাকা বলে জানাচ্ছেন গরু ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ একটি গরুতেই প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪০০ টাকার মতো সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গরু কেজি ৫০০ টাকা নির্ধারিত হলেও মূল্য হতো ২ লাখ ৪০ হাজার হাজার টাকা। এইভাবে নিচের গ্রেডে কেজি প্রতি আরও কম দামেও গরু বিক্রি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিলাম চলাকালে সরকারি যে দর ঘোষণা করা হয়েছে, তার চেয়ে ৬০০ টাকা বেশি দরে প্রতিটি গরু বিক্রি হয়েছে। নিলামের শর্ত ছিল, প্রতিবার ডাক ধরার সময় সরকারি মূল্যের চেয়ে ২০০ টাকা করে বেশি বলতে হবে। সে অনুযায়ী সিন্ডিকেটের সদস্যরা ২০০ টাকা করে বেশিই ডেকেছেন। তিন জনে ২০০ করে মোট ৬০০ টাকা বাড়িয়ে গরু কিনে নিচ্ছিলেন। প্রতিটি গরু তিন জনের ডাকা হলে আর অন্য কেউ ডাকছিলেন না। বাধ্য হয়ে ঘোষণা দেওয়া সরকারি দরের চেয়ে মাত্র ৬০০ টাকা বেশি পেয়েই গরু বিক্রি করেন কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ উঠেছে, প্রথম দফায় খামার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গরু কিনে সোমবার দুপুরের পর একই স্থানে নিলামের মাধ্যমেই গরু বিক্রি করে এই সিন্ডিকেট। দ্বিতীয় দফার এ নিলামে সাধারণ মানুষ অংশ নিয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বেশি দামে গরু কিনতে বাধ্য হন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, নিলামের শুরুতেই ৪৭০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড় আনা হয়। ষাঁড়টির সরকারি ডাক হাঁকা হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রথমেই কালু ষাঁড়ের দর হাঁকেন ১ লাখ ২৫ হাজার ২০০। এরপর তাজমুল ১ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ এবং শেষে মেহেরাব ১ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা দর হাঁকেন। এর পর আর কেউ ডাকেননি। এক মিনিটের মধ্যে মেহেরাবের দর ১, ২, ৩ ঘোষণা দিয়ে তার কাছে এ গরু বিক্রি করা হয়। এ সময় উপস্থিত সিন্ডিকেটের শতাধিক সদস্য হাততালি দিতে থাকেন।

দ্বিতীয় লটে প্রায় একই ওজনের আরেকটি ষাঁড়ের সরকারি দর হাঁকা হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর সেই তাজমুল, মেহেরাব ও কালু ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে ষাঁড়টির দর হাঁকেন। শেষে ১ লাখ ২০ হাজার ৬০০ টাকায় ষাঁড়টি কেনা হয় কালুর নামে।

আরেকটি বড় ষাঁড়ের দর হাঁকা হয় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আবার সেই মেহেরাব, কালু ও তাজমুল ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে দর হাঁকেন। ১ লাখ ২৮ হাজার ৬০০ টাকায় এ ষাঁড়টি কেনা হয় তাজমুলের নামে। মেহেরাব, কালু ও তাজমুলের বাইরে একইভাবে ২০০ টাকা করে দর বাড়িয়ে গরু কিনেছেন উৎসব ও লতিফ। এই পাঁচ জনের বাইরে আর কেউ নিলামে অংশ নেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই সিন্ডিকেটকে সহযোগিতা করেছে প্রাণিসম্পদ দফতরেরই কিছু কর্মকর্তা। এই গরু বিক্রির জন্য দুইটি কমিটি আছে। মূল্য নির্ধারণ ও নিলাম কমিটি। মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও নিলাম কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। নিলামের অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণের জন্য রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, এখানে যে সিন্ডিকেট হয়েছে এটা সত্য। তবে এখানে আমাদের কারও সংশ্লিষ্টতা নেই। ৩ শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ৫ জনের দাম হাঁকার বিষয়টি অস্বাভাবিক। আর এখানে কেউ যদি দাম না বললে আমাদেরও কিছু করার থাকে না। আমরা নিয়ম অনুযায়ীই গরু বিক্রি করেছি। আর এসব গরু কোরবানির গরুর মতো হয় না। যে গরুগুলো এই খামারে অচল সেগুলোই বিক্রি করা হয়। বর্তমান বাজারমূল্যে এই গরু কখনোই বিক্রি হবে না। একারণেই ১২ টি গরু এখনও অবিক্রিত থেকে গেছে।

এখানে সিন্ডিকেট হয়ে স্বীকার করে রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরিচালক ও নিলামে মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ডা. আব্দুল হাই সরকার বলেন, সিন্ডিকেট হয়েছে। তবে এখানে আমাদের কোনও কর্মকর্তা জড়িত নেই। আমরা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিলামের জন্য একটা মূল্য নির্ধারণ করি। সেটি ঢাকা থেকে অনুমোদিতও হয়েছে। আর এই নিলাম নিয়ে প্রতিবছরই সমালোচনা হয়। কেউ বলেন দাম কম হয়েছে। কেউ বলেন দাম বেশি হয়েছে। আর একটি বিষয় হলো বাইরের গরুর দামের সঙ্গে এখানকার গরুর তুলনা হবে না। কারণ এগুলো এভারজে হয়ে গেছে। আর কিছু আছে যেগুলো মাংস উপযোগী না।

রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটেও সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুলেছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। রাজশাহী নগরীর খালেদ সাইফুল্লাহ বুলবুল মঙ্গলবার (১১ জুন) পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাটে গরু কিনতে যান। তিনি বলেন, ৩ মণ ওজনের একটি গরু ১ লাখ ১০ টাকার নিচে দাম হাঁকার পরও বিক্রেতা তার কাছে গরু বিক্রি করেনি। তিনি জানান, বর্তমানে বাজারে রাজশাহী নগরীতে ৭৫০ কেজি দরে কসাই মাংস বিক্রি করছেন। আর হাটে যে দামে হাঁকা হচ্ছ তাতে মাংসের কেজি দাঁড়ায় ৮৭৫ টাকা। অনেকটা ৩৫ হাজার টাকা মণ দরে গরুর দাম নির্ধারিত হচ্ছে। হাটেও মধ্যস্বত্তভোগী দালাল সিন্ডিকেটদের কারণে প্রকৃত মালিকরা দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.