মঙ্গলবার | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাংস থেকে সম্ভাব্য রোগ ছড়ানো ঠেকাতে যেসব কাজ করতে হবে

কাঁচা রক্ত, পশুর মলমূত্র মাখামাখি হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। আর এ থেকেই আপনার পরিবার পড়তে পারে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই জেনে নেওয়া উচিত, কী ধরনের জীবাণু কাঁচা মাংস থেকে ছড়াতে পারে, আর তার জন্য কী করা উচিত।

সারা বছর আমরা কসাইয়ের দোকান বা সুপারশপ থেকেই মাংস কিনি, তারপর সেটা প্যাকেট করে ফ্রিজে রেখে খাই। একমাত্র কোরবানির ঈদের দিনই আমাদের নিজেদের বাড়িতে বা উঠানে, কিংবা কার পার্কিংয়ে গরু, খাসি কোরবানি দেওয়া হয় এবং সরাসরি সেখান থেকে কাঁচা মাংস আমাদের রান্নাঘরে এসে প্রবেশ করে। এই কাঁচা মাংস ব্যবস্থা করার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় এ থেকে ছড়াতে পারে নানা রোগ। বাসার নিচেই মাংস কাটাকুটি হচ্ছে, সেটা আবার পাত্র বা গামলায় করে সিঁড়ি বা লিফট বেয়ে ঘরে আনা হচ্ছে, ঘরে আবার সেটা হয় সরাসরি রান্নার চুলায় চলে যাচ্ছে বা প্যাকেট হচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতার দিকটি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। কাঁচা রক্ত, পশুর মলমূত্র মাখামাখি হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। আর এ থেকেই আপনার পরিবার পড়তে পারে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই জেনে নেওয়া উচিত, কী ধরনের জীবাণু কাঁচা মাংস থেকে ছড়াতে পারে, আর তার জন্য কী করা উচিত।
কাঁচা মাংস যিনি হাত দিয়ে ধরছেন, কাজ শেষ হওয়ামাত্র সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে
কাঁচা মাংস যিনি হাত দিয়ে ধরছেন, কাজ শেষ হওয়ামাত্র সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবেছবি: নকশা

ফিতা কৃমি

টেপ ওয়ার্ম বা টিনিয়া বা সাদা বাংলায় ফিতা কৃমি মূলত আধা সেদ্ধ বা কাঁচা মাংস থেকেই ছড়ায়। সঠিক প্রক্রিয়ায় মাংস পরিষ্কার, সেদ্ধ বা রেফ্রিজারেটর না করলে আপনি এই পরজীবীতে আক্রান্ত হতে পারেন। সাধারণত গরুর মাংসে থাকে টিনিয়া সাজিনেটা। শিশু টিনিয়াকে বলে সিস্টিসারকাই, যা পশুর মাংসের মধ্যে বছরে পর বছর রয়ে যেতে পারে। এই মাংস দ্বারা সংক্রমিত হলে মানুষের অন্ত্রে গিয়ে তা বড় কৃমিতে পরিণত হয়, ডিম ছাড়ে। এমনকি এ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে।

ট্রাইচিনেলা বা গোল কৃমি

পশু যদি আগে থেকে গোল কৃমি বা ট্রাইচিনেলার লার্ভা দ্বারা সংক্রমিত থাকে, তবে সেই পশুর মাংসের মাধ্যমে তা সংক্রমিত হতে পারে। এখানেও ভালো করে পরিষ্কার আর সেদ্ধ না করলেই কেবল ঝুঁকি বাড়ে। আধসেদ্ধ স্টেক, সালামি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ।

ই কোলাই

সাধারণত এই ব্যাকটেরিয়া পশুর মল এবং বৃহদন্ত্রে থাকে। কোরবানির মাংস কাটাকুটির সময় পশুর মল দ্বারা দূষিত হয়ে যেতে পারে। কারণ, এখানে জবাই, ছাড়ানো, কাটা ও প্রসেস—সব একই জায়গায় করা হয়ে থাকে। ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার না করলে ই কোলাই লেগে থাকতে পারে মাংসে। যাঁরা গরুর ভুঁড়ি খেয়ে থাকেন, তাঁরা মনে রাখবেন যে ভুঁড়ি হচ্ছে বৃহদন্ত্র। আর বৃহদন্ত্রে ই কোলাই ভরা। তাই খুব ভালো করে সেদ্ধ করে একে আগে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। ভুঁড়ি যিনি পরিষ্কার করেন বা হ্যান্ডেলিং করেন, তার হাত ই কোলাই দ্বারা দূষিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক।

ক্যামপাইলোব্যাকটার ও ইয়ারসিনিয়া

এ ধরনের জীবাণু সাধারণত প্রক্রিয়াজাত মাংস থেকে ছড়ায়। সসেজ, স্টেক, বার্গার প্যাটি ইত্যাদি করার জন্য আজকাল অনেকেই কোরবানির পশুর মাংস রেখে দেন। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত ও ফ্রিজিং না করা হলে এসব সংক্রমণ হতে পারে। ক্যামপাইলাব্যাকটার সংক্রমণ হলে পেটব্যথা, জ্বর, ডায়রিয়া হতে পারে। তবে এর একটি উল্লেখযোগ্য জটিলতা হলো জিবিএস। আবার ইয়ারসিনিয়া হলে অন্ত্রে প্রদাহ হয় এবং পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি হতে পারে। শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়।
কাঁচা মাংসে নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী এমনকি টক্সিন থাকতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক
কাঁচা মাংসে নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী এমনকি টক্সিন থাকতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনকছবি: নকশা

সালমোনেলা

সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হলে টাইফয়েড জ্বর হয়। পশু এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত থাকলে ঠিকমতো রান্না না করা মাংস থেকে সালমোনেলা ছড়াতে পারে। আবার যিনি মাংস কাটাকুটি বা প্রসেস করছেন বা রান্না করছেন তাঁর হাত ঠিকমতো ধোয়া না হলেও তার থেকে এটি ছড়াতে পারে।

ওপরের জীবাণুগুলো ছাড়াও কাঁচা মাংসে নানা ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী এমনকি টক্সিন থাকতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এ কারণে সচেতনতা জরুরি।

কী করবেন

মাংস কাটাকুটির দুই ঘণ্টার মধ্যে ফ্রিজ করা ভালো। অনেকে কোরবানির মাংস দীর্ঘ সময় ফেলে রাখেন এবং অনেক দেরিতে ফ্রিজে ঢোকান। এটা ঠিক নয়। ফ্রিজিং করার সময় এগুলোকে সঠিকভাবে প্যাকেট করতে হবে যেন ওপরের অংশ মসৃণ থাকে এবং আর্দ্রতা রক্ষিত হয়। মাইনাস তাপমাত্রায় ফ্রিজিং করতে হবে।

মাংস রান্না করার সময় ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। যখন মাংসের গোলাপি ফাইবার বা আঁশগুলো আর দেখা যাবে না এবং মাংসের টুকরার ভেতর থেকে আর রস বের হবে না, তখন বুঝবেন ঠিকভাবে রান্না করা হয়েছে। রান্নার সময় টুকরা মাংসের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমপক্ষে ৬৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং কিমার মাংসের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমপক্ষে ৭১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কাঁচা মাংস যিনি হাত দিয়ে ধরছেন, কাজ শেষ হওয়ামাত্র সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, যিনি মাংস টেনে আনছেন, তিনি ওপরে এসেই আবার চা বানাচ্ছেন বা শিশুদের জন্য খাবার তৈরি করছেন—এমনটা কখনোই করবেন না।

গ্রিল, শিক বা ওভেন বেক করা মাংসের পদ তৈরি করার সময় লক্ষ করবেন মাংসের ভেতর ভালো করে সেদ্ধ হলো কি না এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাল কি না।
কোরবানির দিন কাজের শুরু আর শেষে ভালোভাবে ঘর পরিষ্কার করে নিন
কোরবানির দিন কাজের শুরু আর শেষে ভালোভাবে ঘর পরিষ্কার করে নিনছবি: নকশা

মাংস কাটাকুটিতে ব্যবহৃত দা, বঁটি, ছুরি ভালো করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মাংস পরিবহন করতে যে পাত্র, গামলা, বালতি ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোও ভালো পরিষ্কার হতে হবে।

কোরবানি শেষ হওয়ার পর ঘরে বা পার্কিংয়ে লেগে থাকা সব রক্ত, ময়লা, মলমূত্র ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে

Please Share This Post in Your Social Media



© 2023 priyorajshahi.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.